প্রথম দফার মতো বাংলাদেশে চান্দিকা হাথুরুসিংহের দ্বিতীয় অধ্যায়ও শেষ হলো মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে এই শ্রীলঙ্কানকে অব্যাহতি দিল বিসিবি।
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে বিসিবিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কিছু ব্যাপার নিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছে হাথুরুসিংহেকে। নতুন কোচ হিসেবে ফিল সিমন্সের নাম ঘোষণা করেন বিসিবি প্রধান। ক্যারিবিয়ান এই কোচের সঙ্গে আপাতত আগামী চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত চুক্তি বিসিবির।
বিসিবি সভাপতি জানান, মূলত অসদাচরণের জন্যই হাথুরুসিংহেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
“আমাদের বর্তমান কোচের ব্যাপারে… দু-তিনটি ঘটনা ঘটেছে, যা আসলে খুব পীড়াদায়ক ছিল আমার জন্য, সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে। দলের জন্যও খুব ভালো ব্যাপার ছিল না আর কী। সেদিক বিবেচনা করে তাকে আমরা শোকজ নোটিশ অ্যান্ড সাসপেনশন ফ্রম ডিউটি অ্যাজ হেড কোচ আজকে সার্ভ করেছি। এই প্রক্রিয়াগুলো খুব সহজ নয়, আইনি ব্যাপার থাকে।”
“হাথুরুর সাসপেনশন হলো…৪৮ ঘণ্টার একটা নোটিশ দিয়েছি। মিসকান্ডেক্ট-এর কারণে যখন একটা কোচের বা কারও চাকরি যায়, তখন কিন্তু খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না নোটিশ দেওয়ার। তবে যেহেতু তিনি শুধু আমাদের কোচই নন, একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তি এবং এটা দেশের সীমানার বাইরে যাবে, এজন্য আমরা নিজেদের দেশের ও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করতে চাই। এজন্য ৪৮ ঘণ্টার নোটিশ দিয়েছি। ইমিডিয়েট ক্ষেত্রে আমরা তাকে সাসপেন্ড করেছি, তার পর টার্মিনেশন হবে।”
বিসিবি প্রধান পরে আরও বিস্তারিত উল্লেখ করে জানান, ‘মিসকন্ডাক্ট উইথ আ প্লেয়ার অ্যান্ড মিসকন্ডাক্ট অ্যাজ আ এমপ্লয়ি’, দুই কারণেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে হাথুরুসিংহেকে নিয়ে।
গত বছর ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ চলার সময় বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদের গায়ে হাত তোলার অভিযাগ উঠেছিল হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপ ব্যর্থতা নিয়ে গঠিন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এই ঘটনা উঠে এসেছিল বলে জানা গিয়েছিল। যদিও আগের বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান তা এড়িয়ে গেছেন বা অস্বীকার করেছেন বারবার। তবে এখন সেটিই আনুষ্ঠানিকভাবে সত্যি প্রমাণিত হলো। এছাড়াও সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভেঙে কোচ অতিরিক্ত ছুটি কাটিয়েছেন বলেও জানান ফারুক।
নতুন কোচ সিমন্স ক্রিকেট বিশ্বে পরিচিত নাম। দুই দফায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ছিলেন তিনি, তার কোচিংয়েই ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় করে ক্যারিবিয়ানরা। এর আগে-পরে মিলিয়ে জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ডের প্রধান কোচ ছিলেন তিনি, ব্যাটিং কোচ ছিলেন আফগানিস্তান দলের। এছাড়াও নানা সময়ে বিভিন্ন দলের পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞ কোচ হিসেবে কাজ করেছেন, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোয় প্রধান কোচসহ নানা ভূমিকা পালন করেছেন। তার নতুন চ্যালেঞ্জ এবার বাংলাদেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই শুরু হচ্ছে ৬১ বছর বয়সী এই কোচের দায়িত্ব।
আগের দফায় হাথুরুসিংহে নিজেই বাংলাদেশের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। এই দফায় দুই বছরের চুক্তির মাস পাঁচেক বাকি থাকতেই চাকরি হারালেন ৫৬ বছর বয়সী কোচ।
গত অগাস্টে ফারুক আহমেদ বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরই হাথুরুসিংহের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল নিয়মিত। বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে হাথুরুসিংহের কোচের প্রবল সমালোচকদের একজন ছিলেন তিনি। নানা সময়েই সেই ভাবনা তিনি তুলে ধরেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার কদিন আগেও ‘নট আউট নোমান’ ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হাথরুসিংহেকে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্বে রাখার কোনো কারণ তিনি দেখেন না।
বিসিবি সভাপতি হওয়ার পর গত প্রায় দুই মাসে নানা সংবাদ সম্মেলনে কোচ নিয়ে প্রশ্ন নিয়মিতই শুনতে হয়েছে ফারুককে। তিনি বারবার অনুরোধ করছিলেন অপেক্ষা করতে। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।
প্রথম দফায় ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব নেন হাথুরুসিংহে। তার দুই বছরের মেয়াদ পরে বাড়ানো হয় ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তার কোচিংয়ে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলাসহ ওয়ানডেতে অভাবনীয় সব সাফল্য পায় বাংলাদেশ, স্মরণীয় কয়েকটি জয় ধরা দেয় টেস্টেও। তবে নানা বিতর্কেও তার নাম জড়াতে থাকে। বিশেষ করে ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ড্রেসিং রুমের আবহে অবনতি নিয়ে তার বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। পরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথেই পদত্যাগ করেন তিনি।
এর কিছুদিন পরই নিজ দেশ শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেন সাবেক এই অলরাউন্ডার। কিন্তু সেখানেও নানা টানাপোড়েন ও বিতর্কে জের ধরে তিন বছরের চুক্তির মাঝপথেই বরখাস্ত করা হয় তাকে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচিং করাচ্ছিলেন তিনি।
গত বছরের ৩১ জানুয়ারি বিসিবি জানায়, আবার কোচের দায়িত্বে ফেরানো হচ্ছে হাথুরুসিংহেকে। দুই বছরের চুক্তিতে কাজ শুরু করেন তিনি গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। এবারও শেষ পর্যন্ত মাঠের বাইরের নানা ঘটনা ও বিতর্ক কাল হলো তার জন্য।
এই দফায় তার কোচিংয়ে ১০ টেস্ট, ৩৫ ওয়ানডে ও ৩৫ টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। টেস্টে জয়-হার সমান ৫টি করে। আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়ের পাশাপাশি সেখানে আছে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিলেটে দারুণ এক জয় এবং পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়। আবার শ্রীলঙ্কার কাছে বাজেভাবে হার এবং কদিন আগে ভারত সফরে বিব্রতকর পরাজয়ও আছে।
ওয়ানডেতে জয় এসেছে ১৩টি, হার ১৯টি, পরিত্যক্ত হয়েছে তিন ম্যাচ। গত বিশ্বকাপে প্রবল আশা নিয়ে গিয়ে চরম হতাশাজনক পারফরম্যান্স করে ফেরে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে জয় ১৯টি, হার ১৫টি, পরিত্যক্ত এক ম্যাচ। এই সংস্করণেও গত বিশ্বকাপে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি দল। সূত্র : বিডি নিউজ
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ