ভারতীয় ধনকুবের এন আর নারায়ণ মূর্তি গত ৬ আগস্ট ড. ইউনূসের প্রশংসা করে ‘দ্য প্রিন্টে’ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে ইউনূসের ভাবনা-চিন্তা এই অস্থির সময়ে যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
গত অর্ধশতকজুড়ে এশিয়ার বিশাল অংশে (অবশ্যি দক্ষিণ এশিয়াসহ) উদ্যোক্তারাই ব্যবসার মূল উৎস। আধুনিক এ বিশ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের অবদানের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। ভারতও এর বাইরে উপযোগী সরকারি নীতি তাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে, তাদের অবদান বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সমাজকে উপকৃত করে আসছে।
এই উদ্যোক্তাদের অনেকেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাভজনক ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে, যার ফলে অন্যরা সম্পদের মালিক হতে পারছে এবং সমাজে উদ্যোক্তাদের এই প্রতিভা ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সাহায্য করছে। এই উদ্যোক্তারা বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে যা সৃজনশীল উপায়ে সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কিছু লাভজনক আবার কিছু অ-লাভজনক। এছাড়া বেশ কিছু হাইব্রিড প্রকৃতির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সব উদ্যোক্তাদের যে বিষয়টিতে মিল রয়েছে তা হল সমাজের দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা, অসুস্থতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যাগুলোর বিষয়ে তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা অভিন্ন। তাদের এই চিন্তা প্রকৃতপক্ষে সমগ্র জাতির পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাজার, প্রযুক্তি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই অঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশের একমাত্র অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি গত শতকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অন্তত কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তার তৈরি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বিশ্বমানের। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় তিনি তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোটা পৃথিবীর কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। সামাজিক উন্নয়নে তিনি যে মডেল তৈরি করেছেন তা এখন বিশ্বব্যাপী চর্চিত হচ্ছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ এখন রীতিমতো গবেষণা করছেন। তার তৈরি মডেলগুলো ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, কেনিয়া এবং ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় অঞ্চলেও চর্চিত হচ্ছে।
ঐতিহ্যবাহী এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের একটি প্রজন্মের চিন্তাভাবনা ও কাজের ওপর তার প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অবশ্যই তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। সমাজের দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থান তৈরিতে বেশ ভূমিকা রয়েছে এই ব্যাংকটির। বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে আজ আমরা ক্ষুদ্রঋণের ধারণা সম্পর্কে জানি। কিন্তু যতক্ষণ না ড. ইউনূস আমাদের দেখিয়েছেন যে, কীভাবে এই ধারণা সমাজে ব্যাপক আকারে প্রয়োগ করা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাছে এই ক্ষুদ্রঋণের ধারণা অযৌক্তিই বলে মনে হয়েছিল।
এই ক্ষুদ্রঋণ ধারণা দিয়ে তিনি এমন কিছু করেছেন যা এক সময় আমাদের কাছে অচিন্তনীয় বিষয় ছিল। গ্রামীণ ব্যাংককে প্রথম দিন থেকেই বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে ইউনূসের ভূমিকা ছিল অনন্য। এর মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি নতুন একটি রূপ পেয়েছে। তার নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংক সফলভাবে প্রমাণ করেছে যে একটি ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রতিষ্ঠানও একটি কার্যকর ব্যবসা হতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের দেয়া ঋণ পুনরুদ্ধারের হার ৯৬ শতাংশের বেশি ছিল, যদিও ব্যাংকটি ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো জামানত গ্রহণ করে না। কিন্তু অনেকেই জানে না যে, ড. ইউনূসের কাজ ক্ষুদ্রঋণকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত দুই দশক ধরে, তিনি প্রথম উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য একটি মডেল তৈরি করেছেন যাকে তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’ বলে অভিহিত করেছেন। পরে এর মাধ্যমে তিনি কয়েক ডজন সংস্থা তৈরি করেছেন যা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ এবং খেলাধূলা খাতে ইতিবাচক ভূমিকার মাধ্যমে সমাজের উন্নতিতে বেশ ভূমিকা রাখছে। অবিশ্বাস্যভাবে, ৮৪ বছর বয়সেও তিনি আগের মতোই গতিশীল রয়ে গেছেন। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে তার চিন্তা পৌঁছে দিতে সারা বিশ্ব ভ্রমণ করছেন।
আজকের অস্থির বিশ্বে, আমাদের ইউনূস এবং তার ধারণার প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক বেশি। তার চিন্তা ভারতসহ ছোট ও স্বল্পোন্নত দেশ এবং অঞ্চলে বেশ কার্যকরী। এই মিশনে ইউনূসকে সমর্থন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তাকে তার ধারণা এবং শক্তিকে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং একাডেমিতে কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে। যেন তিনি যা করতে চান তা সর্বাধিকভাবে করতে পারেন। আমার অদম্য আশা যেকোনো মুক্তসমাজ ড. ইউনূসের অসাধারণ কাজ থেকে উপকৃত হওয়ার আশা করবে এবং তারা তাকে তার মহান কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে দেবে।
ব্যবসায়ীরা প্রায়শই কীভাবে সমাজে বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হবে সে সম্পর্কে কথা বলেন। এছাড়া সামাজিক উদ্যোক্তারাও এই বিষয়টি নিয়ে ভাবেন। এ বিষয়ে ভারতে একটি এজেন্ডা তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে দেশের বাইরের সামাজিক ব্যবসা, বিনিয়োগ, সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এর মতো বিষয়গুলি উৎসাহিত হয়। এক্ষেত্রে ইউনূসের মতো নেতাদের সৃজনশীল দক্ষতাকে উৎসাহিত এবং সমর্থন করার বিকল্প নেই।
যেমন একশন ফর ইন্ডিয়া যা সামাজিক উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে আগ্রহী। এবারের প্যারিস অলিম্পিকে ড. ইউনূসের প্রভাব সবার নজর কেড়েছে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, এবারের অলিম্পিক ফ্রান্সের গ্রামে অনুষ্ঠিত হবে যাতে গেমগুলি শেষ হয়ে গেলে, আবাসন এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নিম্ন আয়ের প্যারিসবাসী সাশ্রয়ী মূল্যে ব্যবহার করতে পারে। আয়োজকরা তার ধারণা গ্রহণ করেছেন এবং তাকে তাদের সম্মানিত অতিথি এবং অংশীদারদের একজন বানিয়েছেন। [সূত্র- দ্য প্রিন্ট]
[লেখক: নাগাভার রামরাও নারায়ণ মূর্তি একজন ভারতীয় বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী। তিনি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা। অবসর নেওয়ার আগে এবং ইমেরিটাস চেয়ারম্যান পদ গ্রহণের পূর্বে কোম্পানির চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নারায়ণ মূর্তির জামাতা।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ