চট্টগ্রাম রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪

অঝোর ধারায় জল, ঝরঝরি অবিরল বরষা ঐ এলো বরষা

পূর্বকোণ ডেস্ক

১৫ জুন, ২০২৪ | ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুলের ভাষায়- অঝোর ধারায় জল, ঝরঝরি অবিরল/ বরষা, ঐ এলো বরষা, ধূসর নীরস ধরা হলো সরসা….। গ্রীষ্মকে বিদায় জানিয়ে এসেছে বাদল দিন, ফুটেছে কদম ফুল। বর্ষা বাঙালি জীবনে চিরকালই কামনার। বর্ষা মানেই সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুলের সুবাস। লেবু পাতার বনেও যেন অন্য আয়োজন। উপচেপড়া পুকুরে রঙিন হয়ে ফোঁটে পদ্ম, সে কেবলই বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি। আহা কত না মধুর এই বরষা! আজ পয়লা আষাঢ়। রূপময় ঋতু বর্ষার প্রথম দিন। বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা ঋতু। বর্ষাকাল চলবে শ্রাবণের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

 

গ্রীষ্মের দাবদাহে হাঁসফাঁস মানুষ কবির মতোই মনে করেন মেঘেঢাকা বৃষ্টির আষাঢ় এসেছে গ্রীষ্মের দীর্ঘ তাপদহনের জ্বালা-যন্ত্রণার যবনিকা টানতে। মুক্তি পেতে যাচ্ছে প্রখর দাবদাহে কাহিল মানুষ, নদ-নদী, প্রকৃতি ও উদ্ভিদরাজি। ঋতুবৈচিত্রের পালাবদলে শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। কবিগুরু আষাঢ়ের বন্দনায় বলেছেন ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া/ মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া।’ আর কবি নজরুল নিজের মনের চঞ্চলতা প্রকাশ করেন এভাবে- রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা/ গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা/ ঘুমন্ত ধরা মাঝে/ জল-নূপুর বাজে,/ বিবাগী মন মোর হলো পথহারা…।

 

কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বর্ষা আবাহনের কথা কে না জানে! ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,/ চলে এসো এক বরষায়/ যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী/ কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি/ কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে/ জলভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে/ তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়…।’ অমর শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন- এল বরষা যে সহসা মনে তাই/ রিম ঝিম ঝিম রিম ঝিম ঝিম গান গেয়ে যাই।

 

জ্যৈষ্ঠের আম কুড়ানোর সুখ থাকলেও দাবদাহ মানুষকে অস্থির করে। বর্ষা রিমঝিম বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব। বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তাই তৃষিত অপেক্ষাতুর প্রকৃতি উন্মুখ। তাপদাহে চৌচির মাঠ-ঘাট খাল-বিল বনবিথিকায় প্রাণের ছন্দ এই বর্ষায়। নদী-নালায় থৈ থৈ পানিতে আবহমান বাংলার রূপ হবে অপরূপ রূপবতী সলিল দুহিতা। বর্ষার সৌন্দর্যে বিমোহিত রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।’ কবি বলেন, ‘বর্ষা প্রথমত আসে বাইরের আকাশে। অন্তরের আকাশে তাকে গান গেয়ে ডেকে আনতে হয়।’

 

প্রকৃতি পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের হৃদয়েও নানাভাবে ক্রিয়া করে বর্ষা। কবিগুরুর ভাষায়: মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে/ রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম…। বর্ষায় মন কখনো ‘ময়ূরের মতো নাচে রে।’ আবার কখনো বেদনার সরোবরেও ডুবায়। ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/ কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা…।’ প্রিয়জন ছাড়া যেন কাটতে চায় না দিন। কারও কারও বুকে বাজে হারানোর ব্যথা। নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীর : ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/ বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না…।’ অন্যত্র প্রেমের কবি লিখেছেনÑ অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/ আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই…।

 

এসব বিবেচনায় বিরহেরও ঋতু বটে বর্ষা। বাদল দিনে বিরহকাতর হয়ে ওঠা বাঙালি মনের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে সমকালীন কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, ‘বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব! হয়তো এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়।’

 

বর্ষা ঘিরে এবারও হবে নাগরিক উৎসব। প্রিয় ঋতুকে নাচ গান কবিতাসহ নানা আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে। ছায়ানট, উদীচীর মতো কিছু সংগঠন এ চর্চা অব্যাহত রেখেছে। চারুকলার বকুলতলা, লিচুতলা, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থানে চলবে বর্ষা বন্দনা। কেউ বর্ষার প্রথমদিন গান গেয়ে নাচ করে ঋতুকে বরণ করে নেবেন। আবার কেউ অপেক্ষা করেন শ্রাবণ পর্যন্ত।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট