বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শিগগিরই বাড়তে শুরু করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, চলতি সপ্তাহের পর থেকে রিজার্ভ আর কমবে না। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বেশকিছু উদ্যোগ এবার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায়, এর সুফল মিলবে। এছাড়া চলতি ডিসেম্বর মাসে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ ও বাজেট সহায়তা আসবে। এর ফলে চলতি মাসে রিজার্ভ কমবে না।’
জানা গেছে, চলতি মাসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে রিজার্ভে বাজেট-সহায়তার ৪০ কোটি ডলার যুক্ত হবে। এ ছাড়া ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি সংস্থাটির পর্ষদে অনুমোদিত হওয়ার কথা। সেদিন অনুমোদিত হলে পরের দিনই দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ডলার রিজার্ভে যুক্ত হবে।
রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য মানুষের ঘরে থাকা ডলার ব্যাংকে ফেরানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবে জমার ওপর এখন থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে খোলা এ ধরনের হিসাব থেকে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো, একাধিক কার্ড ইস্যুসহ বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক নির্দেশনা ব্যাংকগুলোকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্লেখ্য, এখন অনেকেই ডলার কিনে ধরে রাখায় বাজারে নগদ ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে আনতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কেউ যেকোনও প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে ফেরার পর আরএফসিডি হিসাব খুলে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত জমা রাখতে পারে ন। কেউ হয়তো যাওয়ার সময় ৫০০ ডলার সঙ্গে করে নিয়েছিলেন। ফেরার পর ১০ হাজার ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললেও কোনও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না। মূলত মানুষের হাতে থাকা ডলার ব্যাংকে আনতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, এই হিসাবে জমার বিপরীতে দুটি সাপ্লিমেন্টারি কার্ড ইস্যু করা যাবে। সন্তান বা ভাইবোনসহ ব্যাংকগ্রাহকের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি সেই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। এই অ্যাকাউন্ট থেকে দেশের বাইরে শিক্ষার খরচ পাঠানো যাবে। আবার নিজের ওপর নির্ভরশীল তথা– স্ত্রী বা স্বামী, সন্তান, ভাইবোন, পিতামাতার চিকিৎসার খরচও এখান থেকে বহন করা যাবে।
বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারবেন রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীরা: চলমান সংকট কাটাতে বেশি সুদে ডলার আনতে অপর এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীর নামেও বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুবিধাভোগীর নামে খোলা অ্যাকাউন্টে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে অর্থ রেখে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে, অন্যান্য দেশের তুলনায় যা বেশি। প্রবাসীর সুবিধাভোগী ছাড়া অন্য যারা বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারেন, তারাও এ হারে সুদ পাবেন। দেশের বাইরে ধরে রাখা ডলার আনতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক: রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি সহায়তার পাশাপাশি রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য ডলার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে বেশি দামে কেনা ডলার কম দামে কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। যদিও ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ডলার ঘাটতিতে থাকায় তারা এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে। উপরন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের কাছ থেকে ডলার নেওয়ার কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে লোকসান দিতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত ডলার আছে, আমরা তাদের কাছ থেকে তা কিনছি। এতে আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।’
ডলারের দাম কমানো: কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটের মধ্যে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কমাতে বাধ্য করেছে ব্যাংকগুলোকে। ফলে চলতি মাসে ৭৫ পয়সা কমানো হয়েছে ডলারের কেনাবেচার দাম। প্রবাসী ও রফতানি আয় কেনায় ডলারের দাম পড়বে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা, আর আমদানিতে পড়বে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। যদিও খোলা বাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৮ টাকা দরে।
বৈদেশিক এই মুদ্রাটির দাম কমানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে— চলতি হিসাবে এখন ডলারের কোনও সংকট নেই। যেহেতু আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর, এর ফলে সরকার আশা করছে— জিনিসের দাম বাড়বে না। আবার ব্যাংকের টাকাও তুলনামূলক খরচ কম হবে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। নিট রিজার্ভও কমতে কমতে ১৯ বিলিয়ন ডলারের প্রান্ত সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। নিট রিজার্ভ আর ১৩ কোটি ডলার কমলেই তা ১৮ বিলিয়নের (১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন) ঘরে নেমে আসবে। যদিও প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কম।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ: আড়াই শতাংশ হারের সঙ্গে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননার পাশাপাশি রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজীকরণ, অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে। এমনকি রেমিট্যান্স আয় আনার ক্ষেত্রে ফরম-‘সি’ পূরণ করার শর্ত শিথিল করা হয়েছে।
এমএফএসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধি: মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে আগের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি রেমিট্যান্স সুবিধাভোগীর কাছে পাঠানো যাবে। গত ৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট (পিএসডি) এক সার্কুলারে জানিয়েছে, এখন থেকে প্রবাসীরা বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো এমএফএস অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পাঠাতে পারবেন। সরকার বা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রণোদনা আলাদাভাবে এমএফএস অ্যাকাউন্টে জমা হবে। রেমিট্যান্স প্রেরকরা এতদিন সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন।
জানা গেছে, এমএফএস হিসাবের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স দেশে আসে।
বিদেশি ঋণের সুদের ওপর ট্যাক্স দিতে হবে না: বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর ২০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করায় ডলারে নেওয়া বিদেশি ঋণ স্থানীয় ঋণের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর গত ৫ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করেছে।
এর ফলে ব্যবসায়ীদের নেওয়া বিদেশি ঋণের সুদের ওপর নির্ধারিত ২০ শতাংশ ট্যাক্স আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিতে হবে না। ব্যবসায়ীরা জানান, কর ছাড় পাওয়ার কারণে সুদ বাবদ তাদের খরচ ১.৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এতে তাদের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার আগ্রহ বাড়বে। একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কিছুটা স্বস্তিতে থাকবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট অনুযায়ী, জুলাই থেকে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ২০ শতাংশ ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছিল। এতে নতুন করে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কমে যায়। ফলে শর্ট টার্ম ফরেন লোন কমতে শুরু করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত বলেন, গত কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর একটি কারণ, বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমে যাওয়া।
নীতি সুদহার বৃদ্ধি: নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের সুদ ও ঋণের সুদহার আরও বাড়বে। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন। এর ফলে যাদের কাছে ডলার সংরক্ষিত আছে, তাদের অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হয়।
এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ডলারের বিনিময় হারকে বাজারমুখী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার ও ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভের পতন ঠেকানোর উপায় একটাই— তা হলো ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এ এজন্য ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রফতানি আয় বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘হুন্ডি বন্ধ করে রেমিট্যান্স বৈধ পথে নিয়ে আসা ও রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য নিতে হবে বহুমুখী পদক্ষেপ। বিদেশে পড়ে থাকা রফতানি আয় এবং পাইপলাইনে আটকে থাকা অর্থ দ্রুত দেশে আনতে হবে।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
পূর্বকোণ/পারভেজ