চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

আত্মহত্যা: চিনতে হবে সংকেত করতে হবে প্রতিরোধ

অনলাইন ডেস্ক

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ৭:৩৩ অপরাহ্ণ

আজ ১০ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিগত দুই বছরের মতো এবারও প্রতিপাদ্য হলো ‘কর্মের মাধ্যমে আশার সঞ্চার’। বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর ৭ লাখের মতো লোক আত্মহত্যা করে। আর ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলো আত্মহত্যা।

করোনাকালীন একটি গবেষণায় গত মার্চ, ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে, যা এই সময়ে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টটিউটের (২০১৮) জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সি মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং দেড় শতাংশ মানুষ একবার হলেও আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছে। আর নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষদের তিনগুণ। শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার চিন্তা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় দ্বিগুণ। বেশির ভাগ আত্মহত্যার সঙ্গে বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে।

সাধারণত আত্মহত্যা দুই ধরনের হয়।
এক. ইমপালসিভ সুইসাইড। মা কোনো কারণে তার সন্তানকে বকাঝকা করলেন আর সন্তান ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করল।
দুই. পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করা। এক্ষেত্রে অনেক দিন থেকেই আত্মহত্যার পরিকল্পনা করার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করে ফেলে।

‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইডোলজি’র গবেষণায় আত্মহত্যার জন্য যেসব বিষয় সংকেত হিসেবে কাজ করে, সেগুলো হলো—

ক. মৃত্যুসংক্রান্ত কাজ: যে কোনো কাজে (অঙ্কন, লেখা, ফেসবুক পোস্ট) মৃত্যুর সংকেত থাকা। নিজের প্রিয় জিনিস অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কারো সঙ্গে কোনো ঝামেলা থাকলে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা।

খ. কথাবার্তা: যারা আত্মহত্যার চিন্তা করে, তাদের কথায় হতাশা এমনকি সরাসরি মৃত্যুর কথাও প্রকাশিত হয়। যেমন—আমি চলে গেলে কেউ আমাকে মিস করবে না, আমি যদি মরে যেতে পারতাম, আমি চলে গেলে সবাই ভালো থাকবে ইত্যাদি।

গ. শারীরিক পরিবর্তন: খুব দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাঁটা কিংবা ইনজেকশনের সূচের দাগ, যেগুলো জিগ্যেস করলে উত্তর দিতে পারবে না।

ঘ. আচরণের পরিবর্তন: সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। হঠাৎ করেই নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া। যে কাজগুলো করতে একসময় খুব আনন্দ পেত, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া।

ঙ. চাপমূলক ঘটনা: সম্প্রতি পরীক্ষায় আশানুরূপ রেজাল্ট করতে না পারা, ভালোবাসায় ব্যর্থতা, তালাক, হতাশা, চাকরি হারানো, অর্থনৈতিক সমস্যা, জটিল শারীরিক সমস্যা প্রভৃতি থাকলে ব্যক্তির আত্মহত্যা সতর্কসংকেত হিসেবে কাজ করে।

সবাই মিলে দায়িত্ব নিলে অনেকাংশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিজের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আসতেই পারে। তখন কিছু কাজ করলে অন্যের সাহায্য ছাড়াও আত্মহত্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আপনাকে আত্মহত্যার ওয়ার্নিং সংকেতগুলো চিনতে হবে। নিজের ইতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলো খাতায় লিখে তালিকা করে বারবার দেখবেন। যারা আপনাকে বিপদের সময় সহায়তা করতে পারবে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। আত্মহত্যা প্রতিরোধকারী সংগঠন বা কাউন্সিলরের মোবাইল নম্বর হাতের কাছে রাখা, যাতে সংকটের সময়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়।

কারো আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে পরিবারের সদস্যদের অনেক কিছু করণীয় আছে। কোনো রকম বিচার করা ছাড়াই তার কথা সহমর্মিতা দিয়ে শুনতে হবে। তার সঙ্গে সব সময় থাকার চেষ্টা করা, যাতে সে কোনোভাবেই এই সংকট সময়ে একা না থাকে। খুব বেশি সমস্যা হলে সাইকিয়াট্রিস্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট একত্রে কাজ করেন এমন হাসপাতালে ভর্তি করা। আত্মহত্যার চিন্তা কমে যাওয়ার পরেও ফলোআপ কাউন্সিলিং করা, যাতে ব্যক্তি পরবর্তী জীবনে ভালো থাকতে পারেন এবং এমন পরিস্থিতি সহজে মোকাবিলা করতে পারেন।

সামাজিক মাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদ, ছবি, ঘটনা পরিবেশনের ধরন ঝুঁকিপূর্ণ বিষণ্ন জনগোষ্ঠীতে আত্মহত্যার হার বাড়তে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, কোনো তারকার আত্মহত্যার পর সেটা ব্যাপকভাবে প্রচারের কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।

আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মিডিয়াকে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা কোথায় কীভাবে সহায়তা পাবে, সে বিষয়ে তথ্য প্রদান করতে হবে। সংবাদে বিস্তারিতভাবে আত্মহত্যার পদ্ধতির বিবরণও থাকবে না। ছবি, ভিডিও বা আত্মহত্যাকে প্ররোচিত করে এমন বিষয় পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা নিজেরাও আত্মহত্যার ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাদেরও কাউনসেলিং গ্রহণ করতে হতে পারে।

একটি মানুষের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে শুধু নিজের জীবনটাই বিসর্জন দেন না, পাশাপাশি তার পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করা হয়। আত্মহত্যা নিয়ে অনেক ধরনের কুসংস্কার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার ভয়ে মানুষ এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায় না। কেবল এই কুসংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেও আমরা একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে পারি। সুতরাং, আসুন সবাই মিলে একসঙ্গে বৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করে ব্যক্তির মধ্যে আশা জাগিয়ে তুলি এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি। সৌজন্য: ইত্তেফাক

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট