চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

‘ভুল’ যখন ভুল সংশোধনে সঠিক

মেলবোর্ন থেকে

আহমেদ শরীফ শুভ

১১ জুলাই, ২০২৩ | ৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেট একটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছে। আফগানিস্তানের সাথে পরাজয় যতটা অপ্রত্যাশিত তার চেয়েও বেশি অপ্রত্যাশিত অধিনায়ক তামিম ইকবালের আকস্মিক অবসরের ঘোষণা। তাঁর ফর্ম কিছুদিন ধরে সামর্থ্যরে সাথে সুবিচার করতে পারছিল না। সেই সাথে ফিটনেস নিয়েও কিছু প্রশ্ন ছিল। সব কিছু মিলিয়ে তিনি একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিলেন। তবে তাঁর সংবাদ সম্মেলনটি যারা দেখেছেন এবং যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাঁড়ির খবর জানেন তাদের বুঝতে বাকি ছিল না যে এখানে ঘটনার পেছনে ঘটনা রয়েছে আরো কিছু। সিরিজ শুরু হওয়ার আগে তামিমের ফিটনেস নিয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ ও কোচের গণমাধ্যমে বক্তব্য পরিস্থিতিকে এমনিতেই নাজুক করে তুলেছিল। কর্তৃপক্ষের সাথে তামিমের দূরত্বের বিষয়টি আর লুকানো থাকেনি। একথা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে তামিমের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। অন্ততঃ তিনি বিষয়টি সেভাবেই দেখেছেন। তাঁর এই মূল্যায়নটি যদি ভুলও হয়ে থাকতো, তাঁকে সেটি বোঝানোর কিংবা সঠিক চিত্র তুলে ধরার কোন প্রচেষ্টাও দৃশ্যমান হয়নি। তিনি তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একজন মানুষের মতোই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, বোর্ডকে যথাযথভাবে অবহিত না করেই সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রথাগত ও আচরণগত ভুল। তাঁর ফিটনেসের সমস্যা ও ফর্ম নিয়ে একটি মহল চিন্তিত থাকলেও অধিকাংশ ফ্যান ও ক্রিকেট বোদ্ধা এই মুহূর্তে তিনি অবসরে যান এটা চাননি। তিনি তাদের সেই মনোভাবকে উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় কিছু সমালোচকের সমালোচনার মুখে হুট করে অবসরের ঘোষণা দিলেন, এটা তাঁর আবেগগত ভুলও বটে। তবে মনে রাখতে হবে একজন ব্যাটসম্যান কিংবা অধিনায়কের বাইরে তামিম আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন একজন মানুষও বটে। আর এ ধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ক্রিকেটের ইতিহাসে এই প্রথম নয়। গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে সৌরভ গাঙ্গুলির সংঘাত এবং আবেগ বিস্ফোরণের কথা পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে। তাই বলে ক্রিকেটবিশ্ব কিন্তু সৌরভকে অপরিণত বলেনি।
বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ড, কোচ এবং সিনিয়র ক্রিকেটারদের সংঘাত হরহামেশাই ঘটে থাকে। এটা মনে করা ঠিক নয় যে এসব ক্ষেত্রে সব সময়ই ক্রিকেট বোর্ড বা কোচই দায়ী। ক্রিকেটারদের কেউ কেউও কখনো কখনো শৃঙ্খলার সীমা লঙ্ঘণ করেছেন, কিংবা যথাসময়ে সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নেন নি। তবে নিকট অতীতে যদি আমরা মাশরাফির কথা বলি, তাঁকে কি আমরা যথাযথ সম্মান দিয়ে বিদায় জানাতে পেরেছি? তিনি যখন দল থেকে বাদ পড়েছেন তখন তিনি ফর্মের পড়তির দিকে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে, শ্রীলংকা, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা সিরিজ খেলে তাঁকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো যেত, তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেয়ার সুযোগ দেয়া যেত। তার আগে বুলবুলের কথা বলা যায়, তাঁকে যখন দল থেকে বাদ দেয়া হয় তখন কিন্তু তিনি ফর্মেই ছিলেন। কিন্তু নতুনদের স্থান করে দেয়ার জন্য ‘আগামীর কথা ভেবে’ তাকে দল থেকে বাদ দেয়া হলো। এমনি করে আমরা ‘আগামীর কথা ভেবে’ বর্তমানকে বিসর্জন দিয়েছি বহুবার, কিন্তু প্রত্যাশিত আগামীর দেখা পাইনি। নিকট অতীতে পর্দার আড়ালে বিভিন্ন সমীকরণ ও বোর্ড কর্তৃপক্ষের পছন্দ অপছন্দের কারণে মাহমুদুল্লাহকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তারও আগে আমাদের অন্যতম দক্ষ ব্যাটসম্যান মমিনুলের ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তামিমের কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা তিনি তাঁর ব্যাটিং দিয়ে পূরণ করতে না পারলে আমরা হতাশ হবো এটা স্বাভাবিক। আমরা তাঁর কাছে আরো বেশি কিছু চাইবো। কিন্তু তাঁকে বাদ দেয়ার কথা ভাবার আগে আমাদের ভাবতে হবে তাঁর উপযুক্ত বিকল্প বা উত্তরাধিকারীর কথা। ইনিংসের সূচনায় এখনো তিনিই সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিক। এটা ঠিক যে তাঁর স্ট্রাইক রেট আগের মতো নেই। কিন্তু ইনিংসের সূচনায় ১০ বলে ২০ রান করে আউট হয়ে যাওয়ার চেয়ে আমাদের এমন একজনকে দরকার যিনি ৪০ বলে ৫০ রান করতে পারবেন। তামিম ৫০ রান তেমন একটা পাচ্ছিলেন না গত কয়েটি ইনিংসে। কিন্তু এরকমটি আগেও হয়েছে। তিনি আবারো স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। বলা যেতে পারে যে তামিম সারাজীবন খেলবেন না। তাঁর বিকল্প তো এখন থেকেই ভাবতে হবে। খুবই সত্যি কথা। এখন এটি ভাবার সময়ই বটে। ভাবনা এক আর গভীরভাবে ভাবার আগে তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন করা ভিন্ন বিষয়। বড় ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাবিহীন কাউকে হুট করে বিশ্বকাপে সূচনা করতে নামিয়ে দেয়া সেই ব্যটসম্যানের জন্যও স্বস্তির কিছু হবে না। এমনকি আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরলে শুরু করার আগেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। অতীতে আমরা অনেক ক্রিকেটারকে এমন ফার্স্ট ট্র্যাক করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশকে অবশ্যই তামিম,
সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ পরবর্তী অধ্যায় নিয়ে ভাবতে হবে। নতুন দল গড়তে হবে। তবে সেটা করা উচিত ছিল হয় দুই বছর আগে যাতে নতুন ক্রিকেটাররা বড় মঞ্চের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে, নতুবা এবারের বিশ্বকাপের পরে। তামিম, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকরা যদি আমাদের একটি ভালো টুর্নামেন্ট উপহার দিতে না পারে, তবে অনভিজ্ঞ এক ঝাঁক তরুণ আমাদের সে উপহার দিতে পারবেন তা প্রত্যাশা করা বাতুলতামাত্র। বিশ্বকাপের ৩ মাস আগে অভিজ্ঞ খেলোয়ারদের চাপের মুখে রাখলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। তামিমের বেলায় ঠিক সে ঘটনাটিই ঘটেছে তা স্পষ্ট।
হ্যাঁ, সিরিজের মাঝপথে সংবাদ সম্মেলন করে অবসরের ঘোষণা দেয়া তামিমের ঠিক হয়নি। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এবং নানামুখী চাপে থাকা একজন মানুষের সব সময় নির্ভুল থাকা কঠিন। তাঁর অবসরের ঘোষণায় জাতি স্তম্ভিত হয়েছে। তাঁর সমালোচকেরাও বলেছেন, তারা তামিমের অবসর চেয়েছেন তবে ঠিক এভাবে চাননি। তারা কিভাবে চেয়েছেন সেটাও স্পষ্ট করেননি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা গেছে সিংহভাগ মানুষই চেয়েছেন তামিম অবসর থেকে ফিরে আসুন। সে প্রক্রিয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না। কারণ, বোর্ড অধিকর্তা সংবাদ সম্মেলন করে নিজেই তামিমের আবেগ এবং কান্না নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছিলেন। মাশরাফির মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তামিম তাঁর অবসরের ঘোষণা প্রত্যাহার করেন। একটি মহল এই পদক্ষেপকে ‘ভুল’ বলে চিহ্নিত করেছেন। হতে পারে এটি প্রথাসিদ্ধ নয়, হতে পারে একজন ক্রিকেটার কিংবা অধিনায়কের অবসরজনিত সমস্যা সমাধানের চেয়েও প্রধানমন্ত্রীর আরো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ থাকে। কিন্তু ক্রিকেট যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের সবচেয়ে বড় ঐক্যের জায়গা, সেখানে জাতীয় জীবনে ক্রিকেটের গুরুত্ব খাটো করে দেখার কোন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। তামিমের অবসরে যাওয়া ভুল হলে সে ঘোষণা প্রত্যাহার করা ভুল হবে কেন! তা ছাড়া এমন ঘটনা বিশ্ব ক্রিকেটে অভূতপূর্বও নয়। ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের হস্তক্ষেপে ইমরান খান অবসর থেকে ক্রিকেটে ফিরে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন।
আমি বলছি না, তামিম ইকবাল অবসর থেকে ফিরে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ উপহার দেবেন (তবে বিষয়টি একেবারে অসম্ভবও নয়), তবে তাঁর ফিরে আসাই সঠিক। এবারের বিশ্বকাপে আমাদের অবস্থান যাই হোক না কেন, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর সমন্বয়ে গড়া দলই হবে আমাদের সেরা দল। এই বিশ্বকাপের পর তরুণদের নিয়ে দল গঠন করে পরবর্তী বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কথা ভাবা হবে সঠিক। যদি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তামিমের ফিরে আসা ‘ভুল’ পদক্ষেপ হয়ে থাকে, তাহলে সেই কথিত ‘ভুলে’র কারণে হলেও বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটি সঠিক দল নিয়ে মাঠে নামতে পারবে। সুতরাং, এই ‘ভুল’টিই তামিমের সংবাদ সম্মেলনের ভুল কিংবা তারও আগে তাঁকে সেই পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়ার জন্য বোর্ড কিংবা কোচের ভুল শোধরানোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে।
এই সমগ্র ঘটনা প্রবাহে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন তামিম নিজেই। আশা করি তিনি অতিরিক্ত চাপ নেবেন না, তাঁর স্বাভাবিক খেলাটি খেলবেন। এতো চাপ এবং প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারলে নিশ্চয়ই ফ্যানরা তাঁর মূল্যায়নে সদয় হবেন, ফলাফল যাই হোক না কেন। যে সময়টা মাঠের বাইরে থাকছেন সে সময়টায় মানসিক চাপ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি একজন সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নেয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক : অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট