ঢোলের যাদুকর। ঢোলে সুর তোলার খেলায় মেতে উঠা ছিল যেন তাঁর শখ। শৈশব কৈশোরের খেলার সারথি হয়ে উঠে এই ঢোল। ঢোলের সাথেই গড়ে উঠে তাঁর মিতালি। দু’হাতের আঙ্গুল যেন যাদুর কাঠি। গ্রামীণ ঐতিহ্য আর লোকসংস্কৃতির ধারক-বাহক এই ঢোলেরই বরপুত্র ছিলেন একুশে পদক প্রাপ্ত ঢোলবাদক বিনয়বাঁশী জলদাস।
ক্যালেন্ডারের পাতায় সময়টা সূচীত হয় খ্রিষ্টপূর্ব উনিশশত এগারো সালের এক অক্টোবরে। প্রকৃতির কোলজুড়ে তখন মধ্য শরতের চুলখোলা ঢেউ, আর কাশফুলের মনমাতানো ঘ্রাণের মাখামাখি। প্রকৃতি তখন ধ্যানমগ্ন ঋষি যেন। সদ্য কৈশোর উত্তির্ন বালিকার মতোই শহরতলী বোয়ালখালী উপজেলার কোলঘেষে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলীর ত্রিবেণী সংগমের আলিঙ্গনকে ছেড়ে যাওয়ার অভিমানে দু’চোখের অশ্রু গড়িয়ে এগিয়ে যায় এক জলধারা। এই জলধারাকে বুকে ধারণ করে বয়ে চলা যে ছন্দছাড়া জলরাশি, স্থানীয়রা আদর করে ঐ অভিমানি কুমারী জলের নাম রাখে ছন্দারিয়া। পরে যা পরিচিত পায় ছন্দারিয়া খাল নামে।
ছন্দারিয়া খালের পাড় ঘেষে গড়ে উঠা বসতী পরিচয় ধারণ করে জালিক কৈবর্ত সম্প্রদায়ের জেলে পল্লী হিসেবে। বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদন্ডী ছন্দারীয়া গ্রামেরএ জেলেপল্লীরই বাসিন্দাউপেন্দ্রলাল জলদাস ও সরবালা জলদাস’র কোল আলো করে জন্ম নেয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি ঢোল বাদক বিনয়বাঁশী জলদাস।
দেশজ সংস্কৃতির চোখ তখন জাতভেদের ভারি পর্দায় আবৃত। গঞ্জের ঝুপড়ি দোকান থেকে গাঁয়ের পানশালা পেড়িয়ে বাবুদের অন্দরমহল, সমস্ত আয়োজনজুড়ে জাতভেদের অনাবাদি চাষ। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত আর জাত শ্রেণির মনো শাসিত সংস্কৃতির উঠোনে তিনিই প্রথম অজপাড়ার মাটির গন্ধ গায়ে মেখে শোষিত তৃণমূল শ্রেণী থেকে ওঠে আসা মৃত্তিকা পুরুষ।
শহরতলীর এক প্রান্তিক পরিবারে জন্ম নেয়া বিনয়বাঁশীর শিক্ষা অন্বেষনের একমাত্র অবলম্বন ছিল রামসুন্দর বসাক রচিত বাল্যশিক্ষা। বাল্যশিক্ষা আর ঢোল হাতে পেয়েই তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে যেন আত্মস্থ করেছিলেন ছাত্রনং অধ্যায়নং তপোঃ। সেই থেকে
একদিকে বাল্যশিক্ষা পাঠ, অন্যদিকে ঢোল বাজনার তালিম। দুটোকেই পরম শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে গ্রহণ করলেন বিনয়বাঁশী।
প্রকৃত অর্থে মাটি ও মানুষের অন্তপ্রান সত্যিকারের জাতশিল্পী বলে যাঁদের একবাক্যে চিনে নেওয়া যায় বিনয়বাঁশী ছিলেন তাঁদেরই একজন। তখন অশিক্ষা, গোত্রীয় নিগড়, হীনম্মন্যতাসহ সকল সামাজিক পশ্চাদপদত্য, দারিদ্র্য পীড়িত ও শোষিতপনা ছিল জেলে সম্প্রদায়ের নিত্যসঙ্গী। এসব প্রতিকুলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বিনয়বাঁশী উঠে এসেছিলেন মহৎজনের সারিতে। জীবদ্দশার প্রায় ৮০ বছরের জীবনের সিংহভাগই কেটেছে তাঁর ঢোলের প্রেমে।
প্রখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে পরিচয় বিনয়বাঁশীর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। এই লোককবির সাহচর্যে এসেই তিনি নাগরিক সংস্কৃতির পূর্ণ পরিমন্ডলে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। সর্বপ্রথম ১৯৪৫ সালে তিনি কবিয়াল রমেশ শীল’র সাথে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ সংস্কৃতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে অনুষ্ঠিত যুদ্ধবিরোধী শান্তির কবিগানে যোগ দেন। এরপর ১৯৪৮ সালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত কবিয়াল রমেশ শীলের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল শিরোপা জেতার অনুষ্ঠানেও অংশ্রগ্রহণ করেন।
এছাড়া ১৯৫৬ সালে বিনয় বাঁশী জলদাস কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও ঢাকার কার্জন হলের সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি রায় গোপাল ও ফণী বড়ুয়ার দোহার হিসেবে সারা বাংলায় সফর করেন। ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমন্ত্রণে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সংস্কৃতি সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচীর লোকসংস্কৃতি উৎসবে ঢোল বাজিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন জয় করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তিনি ঢোল বাজিয়ে যশোরে অনুষ্ঠিত উদীচীর জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন। ২০০০ সালে গুরুতর অসুস্থ থাকার পরও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
তিনি স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঢোলবাদনের নৈপুণ্য সৃষ্টির পাশাপাশি কবিয়াল রমেশ শীলের সহশিল্পী হিসেবে ৩৫ বছর ধরে একাধারে ঢোল বাজিয়েছেন। বাংলার ঢোল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন ভারত উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। ঢোল ছাড়াও সানাই, বেহালা, দো-তারা, করতাল আর মৃদঙ্গ বাজানোতেও সমান পারদর্শিতা ছিল তাঁর। রমেশ শীল উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবিয়াল আর বিনয়বাঁশী বাংলার বিখ্যাত ঢোলবাদক। এ যেন একেই বৃন্তে দুটি’ফুল কিংবা একেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উৎসবে ঢোল বাদনের জন্য সরকার আমন্ত্রণ করেছিল বিনয় বাঁশীকে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারেননি। তবে তাঁর যোগ্য ছেলে বাবুল জলদাস বাবার হয়ে লন্ডন মাতিয়ে এসেছিলেন। তবে এখনো বিভিন্ন লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বাদনশিল্পী হিসেবে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর দলের ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী পুত্র বাবুল জলদাস এরিমধ্যে আমেরিকা, জার্মানী, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।
আমৃত্যু জন্মভূমির মাটির গন্ধ গায়ে মেখে ভূমিপুত্র হয়ে যেন থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। তাইতো বারবার উপেক্ষা করে বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের নানাপ্রান্তে গিয়ে জৌলুশপূর্ণ জীবন যাপনের ডাক। বিনয় বাঁশী সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন দেশকে। দেশজ সংস্কৃতি আর দেশের মানুষকে। ঢোলের প্রতি ভালোবাসা অন্তপ্রান ছিল আমৃত্যু। জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়েছেন তিনি। কিন্তু বিত্তের দিকে ফিরে তাকাননি ভুলেও। একবার তাঁর ঢোল বাজনায় মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটরাজ উদয় শংকর তাঁর নৃত্যদল ‘মম বাণী’তে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন বিনয়বাঁশীকে। কিন্তু নিজের জন্মস্থান ছন্দারিয়া গ্রাম ছেড়ে এ শিল্পী কোথাও যেতে চাননি।
বীর চট্টলার উজ্জল নক্ষত্র, উপমহাদেশের কিংবদন্তি এ বাদনশিল্পীর মহা প্রয়াণের প্রায় দুই’যুগ অতিবাহিত হতে চললেও তাঁর স্মৃতিরক্ষায় সরকারিভাবে নেয়া হয়নি উদ্যোগ। ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের তৎকালীন দুইজন মন্ত্রী পরিদর্শনে এসে কবিয়াল
রমেশ শীল ও ঢোলবাদক বিনয়বাঁশীর সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিলেও তা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও বাস্তবায়িত হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পালিত হতে দেখা যায়নি এ কিংবদন্তির জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবস।
ব্যক্তিজীবনে বিনয়বাঁশী জলদাস ছয় পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক।তাঁর প্রথম পুত্র সুখলাল জলদাস, দ্বিতীয় পুত্র প্রয়াত হরিলাল জলদাস, তৃতীয় পুত্র বাবুল জলদাস, চতুর্থ পুত্র বাদল জলদাস, পঞ্চম পুত্র রাজ বিহারী জলদাস, ষষ্ঠ পুত্র সুবল জলদাস। এবং তিন মেয়ে সবিতা জলদাস, শ্যামলী জলদাস ও সুজলা জলদাস। স্ত্রী সুরবালা জলদাস ছিলেন তাঁর ছায়া সঙ্গী আর প্রথম সারির সমর্থক। সন্তানদের মধ্যে পিতার লালিত লোকসংস্কৃতি, বাদনপ্রেম আর ঐতিহ্য পরম্পরা রক্তে প্রবাহিত হলেও যাপিত জীবনের কষাঘাত, পরিচিত পরিমণ্ডলের রক্তচক্ষু আর বিবিধ বাঁধাকে পাশ কাটিয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই দূরহ হলেও এই কিংবদন্তির স্মৃতিকে বুকে ধারন করে শুদ্ধতম সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক মেলবন্ধনের নির্মাণ ঘটিয়ে যাচ্ছে তাঁরই দ্রোহিত্র বাদন শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাংবাদিক বিপ্লব জলদাশ।
বিনয়পুত্র ও তৎপিতা বাবুল জলদাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা, সর্বৈব সহযোগিতা আর আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ একযুগের অধিক সময় ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে “বিনয়বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠী”। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোক সাংস্কৃতিক সংগঠনটি বিনয় বাঁশী জলদাস’র জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোলবাদন ছাড়াও শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যতার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করে আসছে। এছাড়া বিনয়বাঁশী’র অপর পুত্র সদ্যপ্রয়াত হরিলাল জলদাসের ছিল গোবিন্দ মহারাজ সম্প্রদায় নামে
স্বনামধন্য কীর্তনীয়া দল।যেটির কার্যক্রম উনার মৃত্যুর পর সাময়িক বন্ধ থাকলেও নিকট আগামীতে পূর্ণাঙ্গ কীর্তনীয়া দলে হিসেবে কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে।বিনয়পুত্র সুখলাল জলদাস আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের পিতার স্মৃতি বিজারিত বাড়িটা ছন্দারিয়া খালের ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বেশ ক’বার ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্থানীয় এমপি ও প্রশাসন। কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আর কেউ খোঁজ নেয়নি। হয়নি কোন অগ্রগতি। নানা ভাবে উদ্যোগ নিলেও জটিলতায় কাঙ্খিত কমপ্লেক্স নির্মাণ এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বিনয় পুত্র এবং বিনয়বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা বাদনশিল্পী বাবুল জলদাস জানান, সমাধিস্থলে সরকারি অর্থায়নে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি এখনো। বিনয় বাঁশীর জন্মভিটার অনেকটায় ইতিমধ্যে ছন্দারিয়া খালে বিলীন হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যরা নানা জনের কাছে ধরনা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। এছাড়া পরিবারিক উদ্যোগ, শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতা আর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার কথাও জানান তিনি।
দেশজ সংগীত আর লোকসংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। ২০০২ সালের আজকের এই দিনে বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ বাদনশিল্পী। এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়ের প্রায় একযুগ পর পারিবারিক উদ্যোগ আর ভাস্কর ডি কে দাশ মামুন’র সার্বিক সহযোগিতায় ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল বিনয় বাঁশীর বাস্তুভিটায় এই বাদনশিল্পীর ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করা হয়। এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে সময় লাগে এক বছর।
আজকের এই দিনে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঢোলবাদক ও রাষ্ট্রীয় একুশে পদক প্রাপ্ত বিনয়বাঁশী জলদাস’র ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এ গুণী শিল্পীকে।
লেখক : সাংবাদিক