
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ফ্রাংকফুর্ট বই মেলার প্রথম দিন। এই বইমেলা নিজের চোখে না দেখলে এর বিশালত্ব ও ব্যাপকতা প্রকাশ করা আমার মতো সাধারণ লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। কলকাতা বইমেলা, ঢাকার বইমেলার সাথে কোনদিক থেকে এর সাথে তুলনা করা যাবে না। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুধু বিশালতার ও ব্যাপকতার দিক থেকে নয়, এর গভীরতা, আধুনিকতা, উৎকর্ষতা, উপস্থাপনায় ও কর্মপদ্ধতি শুধু অভিনব বললে ভুল হবে। প্রথমে বলেছি এই বইমেলা সর্বদিক থেকে বিশ্বের মধ্যে সেরা। লন্ডন বইমেলা কোনদিন ফ্রাঙ্কফুট বইমেলাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সাংহাই বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে কি না তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্বের দিক থেকে সবসময় এগিয়ে থাকবে।
এই বই মেলায় প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেলাম মানুষের এত সমাগম দেখে। বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় প্রকাশকেরা বিভিন্ন লেখক ও পুস্তক বিক্রেতাদের এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে থাকে এই মেলাতে। এছাড়া কেহ যদি অনুবাদ করতে চায়, সে সকল প্রকাশকেরা তাদের সাথে কথা বলার জন্য, শর্তাদি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই মেলাতেই বসেই সম্পন্ন করে থাকে। এই জন্য বিশ্ব মানের প্রকাশকেরা বিরাট জায়গা ভাড়া নিয়ে থাকে। টেবিল নির্দিষ্ট করা থাকে। কে কোন টেবিলে বসবে। প্রায় বছর খানেক আগে থেকে এই এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। একটি নামকরা প্রকাশকের প্রায় ৭০টি টেবিল দেখলাম। এই টেবিলে আলোচনার মধ্যদিয়ে লেখক ও পুস্তক বিক্রেতাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এবারও ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে সুন্দর ছিমছামভাবে সাজানো হয়েছে। জার্মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলকার নাইন ফিতা কেটে বাংলাদেশ বুক স্টল উদ্ভোধন করেন। উদ্ভোধন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কারপ্রাপ্ত বক্তা ও লেখক ড. রবিন গ্যাদার্স, ইউক্রেনের উদীয়মান লেখক মারিয়া মানকো। আমার বড় প্রাপ্তি হলো, সেখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার শ্রদ্ধাভাজন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সাথে। লম্বা চুল ও লম্বা দাঁড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রথমে দেখেই চিনে ফেলি। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটি হঠাৎ দেখে যতই না অবাক হয়েছি, তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছি। বাংলাদেশ বই মেলায় এসেছেন সরকারি পরামর্শক হিসেবে। এরপরই পরিচয় হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলকার নাইনের সাথে। জ্ঞান ও বিনয়ের সমন্বিত রূপ দেখলাম। বসে বসে আমাদের সাথে কথা বললেন। পরিচয় হলো আফসানা বেগমের সাথে। যিনি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক। বাংলাদেশ স্টলের সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলা ভাষায় অনুবাদের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন অনেকে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে মার্কিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ও চিনের বেইজিং লেশাংহুয়াক্সিং ইন্টারন্যাশানাল কালচারাল ডেপেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধিদের সাথে এই ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক আলোচনা হয়েছে।
মেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিন, স্পেন ভারত, তুরস্ক, জাপান কোরিয়ার প্রকাশকদের জমজমাট উপস্থিতি থাকলেও রাশিয়ার উপস্থিতি চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন দেশের। মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে শিশুদের প্রকাশনার বিশাল একটা অংশ জুড়ে আছে মেলায়। সে সাথে আছে শিক্ষা উপকরণের বিশাল সমারোহ। আছে ছাপার উপকরণের আধুনিক পদ্ধতির বিশাল প্রদর্শনী।
এই বই মেলায় গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে নারীদের নিয়ে যার শিরোনামে ছিল ‘প্রকাশনায় অদৃশ নারী’। বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করেন শিশুতোষ প্রকাশনা সংস্থা মযুরপঙ্খির মিতিয়া হাসান। ‘নারীদের সৃজনশীলতা ব্যবহার করেও প্রকৃত স্বীকৃতি তাদের ভাগ্যে জোটে না।’ সেমিনারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, বর্তমান বাস্তবতা মেনে ভবিষ্যতে প্রকাশনা শিল্পে নারীদের স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হবে অদৃশ্য শ্রম নয়, দৃশ্যমান সম্মান। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় এই সেমিনারের প্রধান তিনজন আলোচকের একজন হচ্ছেন বাঙালি ও বাংলাদেশি।
লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক পূর্বকোণ
পূর্বকোণ/ইবনুর