চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

পশ্চিমা দুনিয়ার নতুন বার্তা

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রস্বীকৃতি

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটে গেলো বড় এক ঘটনা। একই সময়ে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বের বহু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো এতদিন এ সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাই এবারকার ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক ক‚টনীতির নতুন অধ্যায় ধরা হচ্ছে।

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই স্বীকৃতি আসলে কী অর্থ বহন করে? এটি কি শুধুই প্রতীকী, নাকি বাস্তবে কোন পরিবর্তন আনবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এর প্রভাব কী হতে পারে?

 

স্বীকৃতি মানে কী?
আন্তর্জাতিক আইনে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার কিছু শর্ত থাকে। যেমন- ১. স্থায়ী জনসংখ্যা, ২. নির্দিষ্ট ভূখন্ড , ৩. কার্যকর সরকার এবং ৪. অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষমতা।
ফিলিস্তিন অনেকাংশেই এই মানদণ্ড পূরণ করে। পশ্চিম তীর ও গাজায় লাখো মানুষের বসবাস; প্রশাসনও আছে, যদিও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় অংশ স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। এবার যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতি দেখাচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়ার একাংশও এখন বাস্তবতাকে মানতে শুরু করেছে।

 

প্রতীকী না বাস্তব?
অনেকে বলবেন, স্বীকৃতি শুধু কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব অনেক। এখন ফিলিস্তিন সহজে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে পারবে। আইসিজে (আন্তর্জাতিক আদালত) বা আইসিসিতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) তাদের অবস্থান আরও শক্ত হবে। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম বিশ্বে নতুন বৈধতা পাবে। তবে স্বীকৃতি মানেই রাতারাতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হয়ে গেলো- এমনটা নয়। ইসরায়েলের দখল, ভেতরের রাজনৈতিক বিভাজন ও নিরাপত্তা সমস্যা রয়ে গেছে।

 

এখন কেন স্বীকৃতি?
আসলে এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ আসেনি। কয়েকটি কারণ আছে-
আন্তর্জাতিক চাপ: গতবছর আন্তর্জাতিক আদালত (ICJ) বলেছিল, ইসরায়েলের বসতি স্থাপন অবৈধ। এ রায়ের পর বিশ্বে নৈতিক চাপ বেড়েছে।
গণমানুষের দাবি: গাজায় সাম্প্রতিক সহিংসতা ও মানবিক বিপর্যয় পশ্চিমা সমাজেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক হিসাব: পশ্চিমা নেতারা বুঝেছেন, ফিলিস্তিন প্রশ্নে আর একপেশে অবস্থান রাখা সম্ভব নয়। মুসলিম বিশ্ব ও গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার জন্যও এ স্বীকৃতি প্রয়োজন।

 

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, স্বীকৃতি দেওয়া মানে ফিলিস্তিনি নেতাদের ‘পুরস্কৃত’ করা, যখন হামাসের মতো গোষ্ঠী এখনও কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রও হতাশা প্রকাশ করেছে, যদিও প্রকাশ্যে তারা মৃদু ভাষা ব্যবহার করেছে।
এতে বোঝা যায়, পশ্চিমা বিশ্বে ফাটল ধরেছে। আগে সবাই একসঙ্গে ইসরায়েলপন্থী অবস্থান নিতো; এখন আর তা নেই। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্ত দেখাচ্ছে, ওয়াশিংটনের ছায়া থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসছে পশ্চিমা দুনিয়া।

 

ফিলিস্তিনের জন্য এ স্বীকৃতির মানে কী?
১. কূটনৈতিক শক্তি: আরও অনেক দেশ এখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী হবে।
২. আন্তর্জাতিক আদালত: যুদ্ধাপরাধ, দখল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ফিলিস্তিনের কণ্ঠ আরও জোরালো হবে।
৩. আত্মবিশ্বাস: বিশ্বমঞ্চে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম আর একেবারে একাকী নয়- এ ধারণা তৈরি হবে।
কিন্তু ফিলিস্তিনের নিজেদেরও কাজ করতে হবে। তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য দরকার। পশ্চিম তীর ও গাজার বিভাজন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দুর্নীতি- এসব যদি চলতেই থাকে, তাহলে স্বীকৃতির পূর্ণ সুফল আসবে না।

 

ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
এ স্বীকৃতির ফলে ফিলিস্তিনে কয়েকটি বড় পরিবর্তন হতে পারে। যেমন-
ইউরোপীয় প্রভাব: ইউরোপের আরও কিছু দেশ হয়তো শিগগিরই একই সিদ্ধান্ত নেবে।
মুসলিম বিশ্বে সমর্থন: পশ্চিমা এই পদক্ষেপ মুসলিম দেশগুলোর আস্থা অর্জনে ভূমিকা রাখবে।
ইসরায়েলের কৌশলগত সংকট: কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার চাপ ইসরায়েলকে আলোচনায় ফিরতে বাধ্য করতে পারে।
আমেরিকার প্রভাব কমা: যুক্তরাষ্ট্র এতদিন প্রধান খেলোয়াড় ছিল। এখন অন্যরা প্রভাব খাটাতে শুরু করেছে।

 

বাস্তব চ্যালেঞ্জ
স্বীকৃতি বড় ঘটনা হলেও বাস্তবতা কঠিন। ইসরায়েল এখনও ভূখন্ডের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। সীমান্ত, জেরুজালেমের অবস্থান, শরণার্থী ইস্যু- সবই অমীমাংসিত। সহিংসতা থামছে না। এই সমস্যাগুলো সমাধান না হলে স্বীকৃতি শুধু প্রতীকী থেকে যাবে।
ফিলিস্তিনকে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন গতি আনতে পারে। তবে এ সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকলে এর সুফল আসবে না। আন্তর্জাতিক সমাজকে এখন আরও এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক সহায়তা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং ন্যায়ভিত্তিক আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।
ফিলিস্তিন প্রশ্নে প্রথমবারের মতো পশ্চিমা বিশ্বে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। এই পরিবর্তন শান্তির পথে এগোয় নাকি আবারও রাজনীতির জটিল খেলায় হারিয়ে যায় সেটিই এখন দেখার বিষয়।

শেয়ার করুন