নেপালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সতর্কবার্তা
হিমালয় কন্যা খ্যাত নেপাল এখন অগ্নিগর্ভ। দেশটি অজনা রাজনৈতিক পথে দাঁড়িয়ে। গত সোম ও মঙ্গলবার তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জেনারেশন জেড বা ‘জেন জি’ আন্দোলনে নেপালের সরকারের পতন হয়েছে । প্রাণ গেছে ৩২ জনের এবং আহত হয়েছে দুইশতাধিক। এই দুই দিনে সরকারের মন্ত্রীদের যাকে যেখানে পেয়েছে বেধড়ক পিটিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীরা অগ্নিসংযোগ করেছেন জাতীয় সংসদ ভবনের অংশ, সিংহদরবার সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদের আবাসন এলাকা এবং মার্কসবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অশান্ত নেপালের দায়িত্ব গিয়েছে সেনাদের হাতে। বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই দেশ জুড়ে কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সেনারা। তবে বৃহস্পতিবার রাতে কারফিউ শিথিল হয়েছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর এলেও বড় ধরনের উত্তেজনার খবর মেলেনি। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণেরা, যাদের অধিকাংশই বেকার বা স্বল্প আয়ের চাকরিতে নিয়োজিত। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা বিলাসী জীবনযাপন করেন, অথচ সাধারণ তরুণেরা চাকরি ও ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যদিও আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সূত্রপাত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা থেকে, কিন্তু এর শিকড় অনেক দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি এবং অকার্যকর শাসনব্যবস্থায়। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভেঙে দিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে প্রধানমন্ত্রী করার দাবি তুলেছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করছেন। এদিকে জেন-জেড আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেক কার্কিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী করার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মতি জানিয়েছেন বলে খবর দিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম।
নেপালে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘জেন-জি’ আন্দোলন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য এক সতর্কবার্তা।
এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ নেপালকে পরিণত করেছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনের নতুন কেন্দ্রে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং ভারত-চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে এর কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টার কারণে দেশটির রাজনৈতিক পরিবর্তন বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। তারা বলেছেন, নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু দেশটির ৩ কোটি মানুষের জন্যই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। বরং এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলবে। কারণ দেশটির রাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার পেছনে কাজ করছে ভারত, চীন ও পাকিস্তান। ভূরাজনীতিবিদরা বলছেন, কাঠমান্ডুতে যা ঘটেছে, তা মূলত গত বছর বাংলাদেশে ও ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় তরুণ-যুবকসহ জনসাধারণের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে লঙ্কান সরকারের পতন ঘটে। এরপর ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এবার সেই পথেই হাঁটল নেপালও। নিউইয়র্ক টাইমসেন ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা আলেক্স ট্রাভেলি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়াদেশগুলোর মধ্যে যে মিল আছে তা হলো; তরুণদের মধ্যে তীব্র বেকারত্বের সমস্যা এবং প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেণির দীর্ঘদিনের প্রভাব।’
নেপাল একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। দেশটিতে বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে ৮টির অবস্থান, যার মধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। ঐতিহাসিকভাবে ভারত-ঘনিষ্ঠ হলেও নেপালের পররাষ্ট্রনীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন এসেছে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অলি চীনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। তার পদচ্যুতি কাঠমান্ডুতে চীনের প্রভাব কমার ইঙ্গিত এবং ভারতের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
সামাজিক আন্দোলন ও রাজনীতিবিদবিষয়ক গবেষক লোকরঞ্জন পরাজৌলি বলেছেন, পরবর্তী অন্তর্বর্তী নেতা সম্ভবত কোনো স্বাধীন ব্যক্তি হবেন, যিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন এবং সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন হবেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নামও সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী নেতার তালিকায় আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্পষ্ট নয়। একইসঙ্গে আলোচনায় রয়েছেন কাঠমান্ডুর তরুণ মেয়র, র্যাপার ও জনপ্রিয় নেতা বালেন্দ্র শাহ, যিনি ২০২২ সাল থেকে নগর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। তবে কাঠমান্ডুর এক প্রবীণ মানবাধিকারকর্মী বলেন, নেতা যেই হোন না কেন, ভারত ও চীন উভয়ই এমন সরকার চাইবে যারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। কোনো পক্ষই অন্যপক্ষের প্রভাব নেপালে বাড়ুক, তা চায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলি সরকার পতনের পর ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে। এমনকি ভারতের বিজেপির কিছু অংশ নেপালের রাজতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে থাকে, যারা মনে করে রানা শাসন ফেরানো দরকার।
এ বছরের শুরুর দিকে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে হাজার হাজার মানুষ রাজকীয় অভ্যর্থনা জানায়, যা রাজতন্ত্রের প্রতি এখনও একটি বড় অংশের জনসমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। যদি বর্তমান সংকটে রাজতন্ত্রপন্থিরা লাভবান হয়, তবে ভারতের ডানপন্থি রাজনীতির জন্য তা ইতিবাচক হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষক আলি হাসান। তবে জেনারেশন জেড আন্দোলনের নেতারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা রাজতন্ত্রে ফিরে যেতে চান না।
নেপাল ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও কৌশলগত দিক থেকে খুব গভীর নয়। তবে অতীতে ভারতকে কৌশলগত বার্তা দিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করেছে নেপাল। ১৯৬০ সালে ভারত যখন রাজা মহেন্দ্রর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে, তখন তিনি পাকিস্তান সফরে যান এবং ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে আতিথেয়তা দেন। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময়ও, মে মাসে নেপাল পাকিস্তানের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানায়, যা দিল্লির উদ্বেগ বাড়ায়। বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও এখন প্রশ্ন উঠছে—নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো তাদের রাজনীতিও কি একই ধরনের গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে পারে?
উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ২০০৮ সালে নেপাল তার শতবর্ষীয় রাজতন্ত্র বিলোপ করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে।
লক্ষ্য নতুন কর্মসংস্থান, মানসম্পন্ন সরকারি সেবা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রত্যাশা। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে, দারিদ্র্য দূর করবে এবং একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলবে। কিন্তু গত দুই দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির বিস্তার এবং স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি এই প্রত্যাশাগুলোকে বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতা হলো নেপালের মানুষ তাদের শাসকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই গত ১৭ বছরে দেশটিতে সরকার বদলেছে ১৩ বার। কোনো সরকারই জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারেনি।
ভারত ও চীনের মাঝখানে স্থলবেষ্টিত নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তবে সর্বশেষ বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় গত সপ্তাহে, যখন সরকার ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও লিংকডইনসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরকারের দাবি ছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম নেপালে কোনও অফিস বা প্রতিনিধিত্বকারী নিয়োগ দেয়নি।
চাপের মুখে মঙ্গলবার সকালে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি নেপালের প্রধানমন্ত্রীর। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এনজিও ফ্রিডম ফোরাম নেপালের চেয়ারম্যান তারা নাথ দাহাল বলেন, এটি ছিল এক অজনপ্রিয় সরকারের মরিয়া চেষ্টা, যাতে সমালোচকদের চুপ করানো যায়। তবে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ শুধু নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নয়, বরং দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, কুশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। ঢাকা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সন্ধানে আছে। কলম্বো অর্থনীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কাঠমান্ডু কোন পথে যাবে সেটি প্রক্রিয়াধীন।’
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টাতে তরুণরা কতখানি পারবে, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম এখন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। আপাতদৃষ্টিতে এটা দুর্নীতিমুক্ত হবে, বৈষম্যহীন হবে এবং তরুণদের প্রত্যাশার দিকে গুরুত্ব দেবে।’
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব দেশের আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট, চাকরির বৈষম্য, গুম, ভোট ডাকাতিসহ মত প্রকাশে বাধা ও শাসক গোষ্ঠীর সীমাহীন দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো ঘিরে। আর এসব কারণে রাজনৈতিক শ্রেণির ওপর মানুষের এখন আর আস্থা নেই বললেই চলে। তাই আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, একই পথে হাঁটলে দীর্ঘদিন যে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক : মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক
পূর্বকোণ/এএইচ