চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

সংবাদ ভাষ্য

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন অশনি সংকেত

‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণা

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

১৮ আগস্ট, ২০২৫ | ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ভিশনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আবারও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। সাংবাদিক শ্যারন গাল-এর প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ‘গ্রেটার ইসরায়েল’-এর ভিশনে আস্থাশীল। এ বক্তব্যের পরপরই আরব ও মুসলিম বিশ্ব থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। কারণ, ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণাটি কেবল একটি রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, এটি বাস্তবে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রস্বপ্ন ধ্বংসের পাশাপাশি প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সার্বভৌমত্বকেও সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে।

 

‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণার উৎস
এই ভিশনের শেকড় নিহিত রয়েছে বাইবেলের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ তত্ত্বে। ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী জায়নিস্টদের একাংশ বিশ্বাস করে, নীলনদ থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ইহুদিদের জন্য নির্ধারিত। আধুনিক কালে এর রাজনৈতিক অর্থ দাঁড়ায়- ইসরায়েল ১৯৪৮ কিংবা ১৯৬৭ সালের সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং পূর্ব জেরুজালেম, ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজা এবং এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর কিছু অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করার আকাক্সক্ষা বহন করে।

 

ফিলিস্তিনের অস্তিত্বের সংকট
নেতানিয়াহুর এই দৃষ্টিভঙ্গি কার্যত ফিলিস্তিনিদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সব স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যায়। ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ মানে হলো ওয়েস্ট ব্যাংক ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের স্থায়ী দখল এবং গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে ফিলিস্তিনিরা চিরস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রহীন ও অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।

 

আরব দেশগুলোর আশঙ্কা
এ ভিশন শুধু ফিলিস্তিনের নয়, বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। জর্ডান দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা করে আসছে যে ইসরায়েল ‘জর্ডানই আসল ফিলিস্তিন’ তত্ত্বে ফিলিস্তিনিদের সেদিকে ঠেলে দেবে। লেবানন দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের আগ্রহ এবং হিজবুল্লাহর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাতের কারণে বিশেষভাবে আতঙ্কিত। সিরিয়া এখনো গোলান মালভ‚মি নিয়ে বিতর্কে রয়েছে, যেটি ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর দখল করে রেখেছে। মিশর, যদিও ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করেছে, তবুও ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণা নতুন করে অবিশ্বাস ও সন্দেহ উস্কে দিচ্ছে।

 

কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
নেতানিয়াহুর মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর আরব লীগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC) ‘সর্বোচ্চ কঠোর ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে। তারা স্পষ্ট করেছে, এই বক্তব্য শুধু ফিলিস্তিন প্রশ্নকেই নয়, বরং আরব জাতীয় নিরাপত্তাকেও সরাসরি হুমকি দেয়। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন বা মরক্কোর মতো রাষ্ট্রগুলোও যারা সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, এবার বিব্রত অবস্থায় পড়েছে।

 

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি
‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ভিশন বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মানচিত্র এক নতুন অস্থিতিশীলতার দিকে যাবে। শান্তিচুক্তি ভেঙে পড়তে পারে, নতুন সংঘাত দেখা দিতে পারে, আর ফিলিস্তিন ইস্যু আরও জটিল রূপ নেবে। এর ফলে শুধু আরব দেশ নয়, বৈশ্বিক কূটনীতিতেও নতুন সংকট তৈরি হবে।

 

উপসংহার
নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণা আসলে এক ধরনের সম্প্রসারণবাদী ঘোষণা। এটি শুধু ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয়কেই ধ্বংস করে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। তাই আরব ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর এবং সক্রিয় কূটনৈতিক পদক্ষেপই হতে পারে এই বিপজ্জনক ভিশনের বিরুদ্ধে কার্যকর জবাব।

শেয়ার করুন