ইউক্রেনে সব ধরনের সামরিক সহায়তা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা শিথিলের পরিকল্পনা করছে তারা।
হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কির মধ্যে বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোয় এই ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল। সিএনএনের খবরে বলা হয়, অস্ত্রের এই চালান স্থগিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথকে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই নির্দেশের পর হেগসেথের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড ও ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ। এরপর ইউক্রেনে অস্ত্রসহায়তা স্থগিত করার পাকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়েছে, পুরোনো চালানের যেসব অস্ত্র ইউক্রেনে যাচ্ছিল, তার সবই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হবে। যেসব অস্ত্র এরই মধ্যে সরবরাহের জন্য উড়োজাহাজে তোলা হয়েছে এবং পোল্যান্ডের ট্রানজিট এলাকায় জাহাজে মজুত রয়েছে, সেগুলোও ফেরত আনা হবে।
৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, জেলেনস্কির উচিত ‘আরও কৃতজ্ঞ’ হওয়া। তিনি বলেন, ‘জেলেনস্কি যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে না আসেন, তাহলে তিনি খুব বেশিদিন টিকতে পারবেন না।’
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে বলেছেন, প্রেসিডেন্টের বার্তা একদম স্পষ্ট যে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী। আমাদের অংশীদারদেরও সেই লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ফক্স নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না ট্রাম্প মনে করবেন ইউক্রেনের নেতারা শান্তির প্রতি অঙ্গীকারের সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সামরিক সহযোগিতা স্থগিত থাকবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করছেন ডেমোক্র্যাটরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘আকস্মিক এমন সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছি। এই যুদ্ধে রাশিয়া যে আগ্রাসী আর ইউক্রেন ভুক্তভোগী তা একেবারেই সুস্পষ্ট।’
জো বাইডেন আরও বলেন, ‘অথচ আমরা এমনভাবে আচরণ করছি যেন পরিস্থিতি উল্টো। রাশিয়ার নির্লজ্জ, নির্মম ও নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে এবং ইউক্রেনীয়দের মাতৃভূমি রক্ষা করতে যে সহায়তা দিয়ে আসা হচ্ছিল, তা এভাবে বন্ধ করে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, যা অবিশ্বাস্য!’
তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ইউক্রেনের পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন ইউরোপের নেতারা। সেই সঙ্গে তারা ইউরোপে নিরাপত্তা জোরদারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের পর মঙ্গলবার এক্স হ্যান্ডলে ভলোদিমির জেলেনস্কি লিখেছেন, ‘আমরা দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত এবং প্রথম ধাপে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ও আকাশে যুদ্ধবিরতি- ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার ড্রোন, জ্বালানি ও অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা নিষিদ্ধ করা – এবং সমুদ্রে যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে কার্যকর করা যেতে পারে, যদি রাশিয়া একই পদক্ষেপ নেয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এরপর আমরা দ্রুত পরবর্তী ধাপগুলো শেষ করতে চাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি শক্তিশালী চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে কাজ করতে চাই। আমি শান্তির প্রতি ইউক্রেনের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। আমরা কেউই সীমাহীন যুদ্ধ চাই না। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমি এবং আমার দল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বে কাজ করতে প্রস্তুত।’
ওয়াশিংটনের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করতেও প্রস্তুত আছেন বলেও জানান তিনি। ট্রাম্পের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে জেলেনস্কি বলেন, ‘গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে আমাদের বৈঠকটি যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। এটি দুঃখজনক যে, এটি এভাবে ঘটেছে। বিষয়গুলো ঠিক করার সময় এসেছে। আমরা চাই ভবিষ্যতে সহযোগিতা ও যোগাযোগ গঠনমূলক হোক। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন জেলেনস্কি।
বিশেষ করে, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, আমরা সেটিকে সত্যিই মূল্যবান বলে মনে করি। আমাদের মনে আছে সেই মুহূর্ত, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনকে জ্যাভলিন মিসাইল দিয়েছিলেন, যা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল। আমরা এর জন্য কৃতজ্ঞ।’
শুক্রবার ওভাল অফিসের বৈঠকের সময়, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার জন্য যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা না দেখানোর অভিযোগ তোলেন। ওই বৈঠকের পরিকল্পনায় ছিল ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার দেওয়া সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টি। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে যখন বৈঠক হয় তখন আর চুক্তিটি হয় নি।
ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহাল স্বলেছেন, ‘মার্কিন সামরিক সহায়তা তাদেরর দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সহায়তাই হাজার হাজার জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে।’ একইসঙ্গে তিনি জানান যে, ‘আমরা সম্ভাব্য সব উপায়ে আমেরিকার শঙ্গে শান্তভাবে কাজ চালিয়ে যাব।’
গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সামনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান জেলেনস্কি। নজিরবিহীন এ ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া হয়।
ইউরোপের নিরাপত্তায় তহবিল গঠনের পরিকল্পনা : মি. ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন ইউরোপের নেতারা। তারা কঠোরভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। সেই সঙ্গে ইউরোপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন। সোমবার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশোতে পোলিস পার্লামেন্টের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড তুস্ক বলেন, ‘সিটবেল্ট বেঁধে প্রস্তুত হোন; আমরা বিশৃঙ্খল এলাকায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি।’ তিনি ইউরোপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শ না করেই সামরিক সহায়তা স্থগিত করেছে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, ইউরোপ তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে প্রস্তুত। এ জন্য তারা ৮৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করবেন বলে জানান তিনি। ডেনমার্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ট্রোয়েল লান্ড গৌলসেন বলেন, কিছু বিষয়ে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এর মধ্যে আছে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্র। এ অবস্থায় ইউরোপকে ইউক্রেনের সহায়তায় আরও বেশি কিছু করতে হবে। এর আগে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনেস্কি বৈঠক পণ্ড হওয়ার পর পরই ইউরোপীয় নেতারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানান। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘তিনি এই সংঘাতে ভুক্তভোগী ও হামলাকারীকে পাল্টে দিচ্ছেন, যা এক নতুন অন্ধকার যুগের সূচনা করতে পারে।’ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এবং পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কও ইউক্রেনের প্রতি তাদের দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করেন।
এদিকে ইউরোপ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেও সামরিক সহায়তা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে রাশিয়া। তারা বলছে, এটা ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে আনতে ভূমিকা রাখবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তা কিয়েভকে শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যাবে। শান্তির জন্য সম্ভবত এটা অত্যন্ত বড় একটি পদক্ষেপ।’
রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পরিকল্পনা : ইউক্রেন ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞামুক্ত করতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় চালু এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি চাওয়ায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আরেকজন জানিয়েছেন। এরই মধ্যে হোয়াইট হাউস মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়কে নিষেধাজ্ঞার পরিধি নিয়ে একটি তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।
লন্ডনে জরুরি সম্মেলন : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে বের করতে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের আমন্ত্রণে রবিবার লন্ডনে একটি জরুরি সম্মেলন করেছেন ইউরোপের নেতারা। এতে ফ্রান্স ও ইতালি ছাড়াও জার্মানি, ডেনমার্ক, তুরস্ক, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতারা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনে যোগ দেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রধান মার্ক রুটে ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। সম্মেলনের পর তাঁরা জেলেনস্কির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানানোর কথা বলেছেন। লন্ডনে সম্মেলন শেষে স্টারমার ইউক্রেনকে রক্ষা করতে ইউরোপীয় নেতাদের একটি ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। স্টারমারের ভাষ্য অনুযায়ী, সম্মেলনে ঐকমত্য হওয়ার চারটি পদক্ষেপ হলো—যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে; স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনকে অবশ্যই রাখতে হবে; শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে কাজ করতে হবে ইউরোপের নেতাদের; ইউক্রেনের সুরক্ষার জন্য একটি জোট গঠন করতে হবে এবং দেশটিতে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে ১৬০ কোটি পাউন্ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিয়ার স্টারমার। যুক্তরাজ্যের দেওয়া এই অর্থ খরচ করে ইউক্রেনের জন্য পাঁচ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হবে। ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে।
লন্ডন সম্মেলনে বেশির ভাগ নেতা খুবই সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, তাঁরা এখনো মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন জরুরি। সম্মেলনের শেষে স্টারমার চার পয়েন্টের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ওই পরিকল্পনায় ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আরও বাড়ানো, যাতে ভবিষ্যতে রাশিয়া আবার আক্রমণ করলে তা প্রতিহত করা যায়। এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ গঠন করা। এর আওতায় ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে।
সদ্য শেষ হওয়া লন্ডন সম্মেলন নিয়ে টেলিগ্রামে জেলেনস্কি লিখেছেন, ‘এখানে আমরা ইউক্রেন, আমাদের জনগণ, সেনাবাহিনী ও বেসামরিক নাগরিক এবং আমাদের স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় সমর্থন অনুভব করেছি।’
‘প্রকৃত শান্তি ও নিশ্চিত নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার শক্ত ভিত্তি গড়ার জন্য আমরা ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে একযোগে কাজ করছি’—যোগ করেন জেলেনস্কি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে বের করতে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের আমন্ত্রণে গত রবিবার লন্ডনে একটি জরুরি সম্মেলন করেন ইউরোপের নেতারা।
শুরু থেকে রাশির-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ট্রাম্প জেলেনস্কিকেই দায়ী করে আসছেন। ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে ‘একনায়ক’ বলে আক্রমণ করেছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ ছিল ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ আরোহণ করা। তবে সরাসরি সম্প্রচারিত সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কির সঙ্গে অপ্রত্যাশিত বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তারপরই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে খনিজ চুক্তি ভেস্তে গিয়েছে। চুক্তির আগে উভয় পক্ষই আশা করেছিল যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের জন্য শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করবে। তবে, শুক্রবার ওভাল অফিসে বৈঠকে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে যখন ট্রাম্প-জেলেনস্কি নজিরবিহীন ভাবে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, উভয় পক্ষই মিডিয়ার সামনে একে অপরকে গালিগালাজ করতে শুরু করে। এরপরই জেলেনস্কি ও তাঁর সহোযোগীদের হোয়াইট হাউস ছেড়ে চলে যেতে বলা হয় ৷ এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি যুক্তরাজ্যে চলে যান জেলেনস্কি। গত শনিবার লন্ডনে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার তাঁকে স্বাগত জানান। ব্রিটিশ রাজা চার্লসের (তৃতীয়) সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন জেলেনস্কি।
মার্কিন ঘাটতি পূরণে ইউরোপ কতটা প্রস্তুত : ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ইউক্রেনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৬৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সহায়তা দিয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়ার আগে কিয়েভের জন্য আরও ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, সামরিক যান ও অন্যান্য সরঞ্জাম অনুমোদন দেন বাইডেন। অপরদিকে, ইউরোপের সামরিক সহায়তার পরিমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেসব বিশেষ সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে, তা ইউরোপের পক্ষে সরবরাহ করা কঠিন হতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক র্যাচেল এলেহুস বলেন, মার্কিন সহায়তা বিশেষত তিনটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ: আকাশ প্রতিরক্ষা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ। ইউরোপের কিছু দেশ যেমন জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন, এর পরিবর্তে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কিয়েলের হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপ মোট ৬২ বিলিয়ন ইউরো সহায়তা দিয়েছে, যা ৬৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ, মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে, ইউরোপকে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে হবে এই ঘাটতি পূরণের জন্য। এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপ কি এই ঘাটতি পূরণে সফল হবে? এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক প্রস্তুতি, কৌশল এবং আর্থিক সক্ষমতার ওপর। ভবিষ্যতে, যদি মার্কিন সহায়তা বন্ধ থাকে, তাহলে ইউরোপকে বৃহৎ দায়িত্বের মুখোমুখি হতে হবে, যা তাদের সামরিক ক্ষমতা এবং একাত্মতার পরীক্ষা নেবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ইউক্রেন নীতিতে পরিবর্তন এনে রাশিয়ার প্রতি আরও সমঝোতামূলক অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে একে ট্রাম্পের স্বার্থ হাসিলের একটি কৌশল হিসেবেই বর্ণনা করেছেন বিশ্লেষকেরা। অনেকেই বলছেন, জেলেনস্কিকে শিগগিরই খনিজ চুক্তিতে স্বাক্ষরে বাধ্য করতেই এই চাল চেলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের এই উদ্যোগের পর রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার জন্য ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হবে কিয়েভের ওপর।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সহায়তা বন্ধ ইউক্রেনের প্রতিরোধের সামর্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই প্রকাশ্য বিরোধ আসলে একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। এতে হয় জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মানতে বাধ্য করা, নতুবা সংকট তৈরি করে পরবর্তী যে কোনো ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হলো। ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, তারা কতটা কার্যকরভাবে এবং কতদিন লড়তে পারবে?
তথ্যসূত্র : সিএনএন, বিবিসি ও গার্ডিয়ান
লেখক : মুহাম্মাদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক
পূর্বকোণ/ইব