ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোর শহরে ১২৫ বছর ধরে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে খ্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতাল। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নেন এ হাসপাতালে। এটিকে কেন্দ্র করে হোটেল-লজ, মানি এক্সচেঞ্জ, ট্রাভেল এজেন্সি, পরিবহন ব্যবসা, বিপণী-বিতানসহ নানা ধরনের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশি সংকটে ধুঁকছে ভেলোরের ব্যবসা-বাণিজ্য।
ভেলোর এম এ ট্যুর এন্ড ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মো. একরাম বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য সিকি পরিমাণ নেমে এসেছে। বাংলাদেশি যাত্রী সংকটে চেন্নাই-ঢাকা রুটে বিমান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। সপ্তাহে দু-তিনটি বিমান চলাচল করে এখন। অথচ আগে যাত্রীর চাপে দিনে এক কোম্পানির একাধিক বিমান চলাচল করতো।
বাবু রয় স্ট্রিটের ওষুধের দোকানি রাজা বলেন, ভিসা জটিলতায় বাংলাদেশি লোকজন আসতে না পারায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব নেমে এসেছে। কয়েক মাস ধরে তা চরম আকার ধারণ করেছে। ব্যবসা চার ভাগের এক ভাগও নেই বললে চলে।
সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে সম্প্রতি ভেলোরে সপ্তাহখানেক অবস্থান করেন এই প্রতিবেদক। ভেলোরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে এ চিত্র দেখা দেখা গেছে। চার মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে। ভেলোর সিএমসি হাসপাতাল ছাড়াও শ্রী নারায়ণী, নারুবী এবং চেন্নাই এপোলোসহ কয়েকটি বিখ্যাত হাসপাতাল রয়েছে। এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। এরমধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি পর্যটক আসেন চিকিৎসাসেবা নিতে। ভারতের চেন্নাই, ভেলোর ছাড়াও কলকাতা, আসাম, ঝাড়খান্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যের লোকজনও চিকিৎসাসেবা নেন এসব হাসপাতালে।
গত সপ্তাহে ভেলোর শহরের হোটেল-লজ, ট্রাভেল এজেন্সি, পরিবহন, পোশাক-পরিচ্ছদ-জুয়েলারিসহ বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, ভেলোরে চিকিৎসা-পর্যটকদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের ঘিরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে তামিলনাড়ুর লোকজন বাংলা ভাষাও আয়ত্ত করে নিয়েছেন। বর্তমানে সব ধরনের ব্যবসায় চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে।
জুয়েলারি দোকানি মীর আহমদ বলেন, পোশাক-পরিচ্ছেদ ও জুয়েলারি পণ্যের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে বাংলাদেশি। এখন বাংলাদেশি ক্রেতা সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য মুশকিল অবস্থা চলছে। প্রতিটি পণ্য এখন লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ভারতীয় লোকজন ভেলোর থেকে তেমন কেনাকাটা করেন না। কারণ ভারতীয় পণ্য নিজ জেলা-শহর পাওয়া যায়।
কলকাতা থেকে আসা এক নারী হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষামাণ কক্ষে বলেন, বাংলাদেশি কম থাকায় হোটেল ভাড়া অনেকটা কম রয়েছে। হাসপাতালেও আগের মতো ভিড় নেই।
প্রবীণ হোটেল ব্যবসায়ী আকবর বশর বলেন, বাংলাদেশি লোকজনের সংখ্যা ৮০-৮৫ শতাংশ কমে গেছে। আয়ও চার ভাগের তিন ভাগ কমে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এমন মন্দাভাব আর হয়নি। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি চিকিৎসা ও ভ্রমণে ভারতে যান। ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, ভেলোর, দিল্লি, বোম্বে, হায়দ্রাবাদসহ বিভিন্ন রাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেন।
পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর ৫ লাখ বাংলাদেশি দেশের বাইরে যায়। যার ৮০ শতাংশ যায় ভারতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ (৬০ হাজার কোটি টাকা) বিদেশে চলে যায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সিএমসি হাসপাতালের প্রধান গেটের বিপরীত দিকে রয়েছে গান্ধী রোড। সকাল-সন্ধ্যা মানুষের ভিড় লেগে থাকে এই সড়কে। সড়কে রয়েছে অসংখ্য ভাসমান দোকান। রয়েছে তৈরি পোশাক, খাদ্যসামগ্রী, জুয়েলারিসহ নানা পসরার সৌখিন মার্কেট-বিপণিকেন্দ্র। এছাড়াও আশপাশের সড়ক-উপসড়ক ও অলি-গলিতে যত্রতত্রভাবে গড়ে উঠেছে হোটেল-লজ, নানা ব্যবসা-বিপণিকেন্দ্র ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে অলিগলি, হোটেল, ফুটপাত ও বিপণিকেন্দ্রের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকাংশ কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়নে ভিসা জটিলতা দেখা দেয়।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন প্রায় ২০ লাখ বিদেশি রোগী। যার ৬০ শতাংশই বাংলাদেশি। গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
সেখানে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সোনিয়া রমজান ও পটিয়ার মনসা এলাকার মোহাম্মদ মনসুর ও আরজু রহমান বলেন, তিন-চার মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশি রোগী অনেক কমে গেছে। হোটেল কক্ষ, রাস্তাঘাট ও হাসপাতালে আগের মতো ভিড় নেই।
পূর্বকোণ/ইব