চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

ইসলামের দৃষ্টিতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপন

মুহাম্মদ মোরশেদ আলম

৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ২:০৭ অপরাহ্ণ

দুয়ারে কড়া নাড়ছে নতুন ইংরেজি বছর ‘২০২৫’। ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টা অতিক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তেই নতুন বছরের সূচনা হবে এবং মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরও একটি বছর। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে খ্রিস্টবর্ষের ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা ১ মিনিটকে থার্টিফার্স্ট নাইট হিসাবে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশেও এ বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথচ কয়েক দশক আগেও দিবসটি দেশে এমন ঘটা করে পালন করা হত না। বিশেষ করে মিলেনিয়াম সহস্রাব্দ (২০০০ সাল) থেকে এর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছে।

 

বলাবাহুল্য, বর্তমান সময়ে এই উৎসবটি বিধর্মীদের পাশাপাশি মুসলিমরাও বিভিন্নভাবে উদযাপন করছে। বিশেষভাবে মুসলিম যুব সমাজের মাঝে এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে অশ্লীলতার ব্যাপক সয়লাব ঘটে। এ রাতে এমন সব অশ্লীলতা প্রকাশ পায়, যা বছরের অন্যান্য সময়ে খুব কমই দেখা যায়। মফস্বলের তুলনায় শহরে অশ্লীলতার মাত্রা থাকে বেশি। শহরের অভিজাত ক্লাব, আবাসিক হোটেল ও বাসা-ফ্ল্যাটে রাতভর চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের মহড়া। কী থাকে না এতে? বস্তুত যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য যা দরকার, তার সবই থাকে এসব অনুষ্ঠানে। গান, বাজনা, ডিজে (অশ্লীল নৃত্য), আতশবাজি, যুবক-যুবতীদের বাধাহীন উল্লাস, শরীরে ট্যাটু অঙ্কন, মাদকদ্রব্য সেবনসহ এমন সব কর্মকাণ্ডর আয়োজন করা হয়, যা তাদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম করতে প্রলুব্ধ করে।

 

‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপন ইসলামে বৈধ নয়। ইসলামি স্কলাররা একে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্য ধর্মের সংস্কৃতি-উৎসব মুসলমানের জন্য উদযাপন করা জায়েজ নেই। বিজাতীয় সংস্কৃতি উদযাপনে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা এমনই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে, কখনও তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৫)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, (হে নবী) আপনি বলুন : নিশ্চয়ই আমার রব হারাম তথা নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অন্যায় ও অসংগত বিদ্রোহ ও বিরোধিতা এবং আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করা, যার পক্ষে আল্লাহ কোনো দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। (সুরা আরাফ : ৩৩)। নিজ ধর্ম ও অন্য ধর্মের কালচারকে গুলিয়ে একাকার করতে বারণ করা হয়েছে হাদিসে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে, সে সেই জাতিরই অন্তর্ভুক্ত। (মিশকাত শরিফ : ৪৩৪৭)। অন্য ধর্মের সংস্কৃতি গ্রহণ না করার জন্য এ হাদিস মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করেছে। আর গ্রহণ করলে মুসলমানিত্ব হারানোর হুঁশিয়ারিও প্রকাশ পেয়েছে। আলোচ্য দুটি আয়াত ও হাদিসটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, মুসলিম ব্যক্তিদের জন্য বিধর্মীদের এই উৎসবটি পালন আল্লাহর পক্ষ হতে সম্পূর্ণ হারাম তথা নিষিদ্ধ এবং যদি কেউ পালন করে তাহলে সে তাদের তথা বিধর্মীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। এমনকি এই উৎসব পালনের নামে সমাজের অসংখ্য ছেলে ও মেয়েদের মাঝে অবাধ চলাফেরা লক্ষ্য করা যায়, যার মাধ্যমে জেনার দ্বার উন্মোচিত হয়। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে এরশাদ করেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সকল নারী পোশাক পরিহিতা, কিন্তু নগ্ন; যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হয়; তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের মতো; তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’ (মুসলিম : ২১২৮)।

 

সুতরাং ইংরেজি নববর্ষের উদযাপন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ। এটা ইসলামি সংস্কৃতি নয়। অথচ আমাদের দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজনে মুসলমানরাও পিছিয়ে নেই। একজন মুসলমান হিসেবে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি আমরা কিছুতেই গ্রহণ করতে পারি না। আল্লাহ তা’আলা বলেন: হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদিগকে বন্ধু-রুপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধু-রূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা:মায়িদা,আয়াত :৫১)

 

থার্টি ফার্স্ট নাইটের সূচনা ও ইতিহাস : নববর্ষ পালনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সর্বপ্রথম মেসোপটেমীয় সভ্যতার লোকেরা নতুন বর্ষ উদযাপন শুরু করেছিল। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ বা আকিতু শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। তারা তাদের নিজস্ব গণনায় বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করত। এর বেশি তাদের ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না। এরপর ব্যক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশেদের কথা জানা যায় যে, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দে ‘নওরোজ’ নামে নববর্ষ পালনের প্রথা চালু করেছিলেন। প্রাচীন পারস্যের মূল ভূখণ্ড ইরানে এ ধারাবাহিকতা আজও বহাল আছে এবং ইরানে ‘নওরোজ’ (নতুন দিবস) ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। দেশটিতে নববর্ষ বা নওরোজ শুরু হয় পুরনো বছরের শেষ বুধবার এবং উৎসব চলতে থাকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত।

 

ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষূবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ জানুয়ারিতে। ইহুদীদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন গোঁড়া ইহুদীদের মতে সেই মাসের দ্বিতীয় দিন। মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ, তারা ধারণা করতো, এদিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর।

 

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে রোমে নববর্ষ পালন শুরু হওয়ার প্রায় একশ বছর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করে। তার সময়ে রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে বছরের প্রথম দিনটিকে জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো। রোমানরা এ দেবতাকে সূচনা বা শুরুর স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করত। এ দেবতার নামানুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় জানুয়ারি। এ মাস শুরু হলে তারা সেলিব্রেট করে তাদের দেবতাকে খুশি করে, যেন সে তাদের বছরটি মঙ্গলময় করে।

 

এটা হলো যিশু বা হযরত ইসা আলাইহিস সালাম এর জন্মের আগে নববর্ষ পালনের ইতিহাস। ইসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তাঁর জন্মের বছরকে সূচনাকাল ধরে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার আনেন, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়ে থাকে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ও আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুসারে জানুয়ারি মাসের প্রথম তারিখ থেকেই শুরু হয় নতুন ইংরেজি বা খ্রিষ্টবর্ষের গণনা। এরপর ঊনিশ শতক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিউ ইয়ার’ পালন শুরু হয়। এই হলো থার্টি ফার্স্ট নাইটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ থেকে জানা যায়, নববর্ষ পালন বিজাতীয় সংস্কৃতি ও বিধর্মীদের কালচার। এর সাথে ইসলামের কোনোই সম্পর্ক নেই। বস্তুত রোমের মুশরিক সম্প্রদায় ও পারস্যের অগ্নিপূজারী জাতি হলো নববর্ষ পালনের উদ্ভাবক। তাই একজন মুসলিম হিসেবে তাদের অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও খ্রিষ্ট নববর্ষ পালনের সাথে শিরকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেননা, জানুস দেবতার নামে মাসের নাম ‘জানুয়ারি’ রেখে সেটার প্রথম তারিখকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে সেলিব্রেট করা হতো। তাই এ উৎসব থেকে মুসলমানদের বিরত থাকা একান্ত জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী, সাহাবিদের জীবনী, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেঈনদের জীবনী, চার ইমামের জীবনী, বিখ্যাত মুসলিম মনীষীদের জীবনী এবং বিভিন্ন ইসলামি খেলাফতের শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা কখনোই বিধর্মীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য এমন কোন উৎসব পালন করেননি, এমনকি থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক উৎসবটিও সমর্থন করেননি।

 

মুসলমানদের করণীয় : বাংলাদেশসহ বিশ্বে যে সময়টিতে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করা হয়, সে সময়টি ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার সময়। এ সময় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে এসে আহ্বানকারীকে (সাহায্য প্রার্থীকে), অসুস্থ ব্যক্তিকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে (চাহিদা অনুযায়ী) যা ইচ্ছা তা ডেকে ডেকে দিয়ে যান। (মুসলিম, মিশকাত)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অন্ধকার রাতের ঘনঘটার মতো ফেতনার আগে দ্রুত আমল কর, (যখন) ব্যক্তি ভোর অতিবাহিত করবে মোমিন অবস্থায়, সন্ধ্যা করবে কাফের অবস্থায় অথবা সন্ধ্যা অতিবাহিত করবে মোমিন অবস্থায়, ভোর অতিবাহিত করবে কাফের অবস্থায়। মানুষ তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেবে দুনিয়ার সামান্য কিছুর বিনিময়ে।’ (মুসলিম)।

 

নতুন বছরের প্রাক্কালে মুসলমানদের করণীয় হল সৃষ্টিকর্তার দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, নিজের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, নতুন বছর যেন সর্বদিক থেকে মঙ্গলময় হয় সেই দোয়া করা। অথচ তা না করে নামসর্বস্ব মুসলমানরা অপকর্ম করে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত থাকে। আল্লাহপাক কুরআন করিমে ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি’ (সুরা তাওবা : আয়াত ৩৬)। তিনি আরো ইরশাদ করেন: ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৫)।

 

তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের উচিত বিধর্মীদের এই সংস্কৃতিকে পরিহার করা এবং এটা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। পাশাপাশি নিজের সন্তান, পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ সবাইকে এই উৎসব পালন সম্পর্কে ইসলামের অভিমত অবহিত করা এবং সবাইকে সতর্ক করা। কেননা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে। (সুরা আত তাহরীম : ৬)।

লেখক : মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন