সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত নারীরা দেশটিতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন, কারণ তাদের সন্তানদের জন্ম সনদ দেয়া হচ্ছে না। তাই নিজ দেশে ফেরার জন্য ভিসা বঞ্চিত হচ্ছেন গৃহকর্মী এসব সিঙ্গেল মাদার। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গার্ডিয়ান সৌদিতে কর্মরত কেনিয়ার নাগরিক পাঁচ নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। গৃহকর্মী এসব নারীরা জানিয়েছেন, তারা তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধন করতে পারেননি, কারণ এসব শিশুরা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। এই নারীরা সবাই নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছেন, যারা তাদের পরিচয়পত্র আটকে রেখেছেন।
এই নারীরা জানিয়েছেন, তারা সৌদি ছেড়ে নিজ দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কারণ তাদের সন্তানরা সৌদি আরবে প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাড়া স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। মায়েদের জানানো হয়েছে যে, তারাও দেশছাড়ার ভিসা পাবেন না, কারণ তাদের সন্তানরা ‘রাষ্ট্র পরিচয়হীন’ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
সৌদি আরবের ইসলামিক আইন অনুযায়ী, বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক একটি অপরাধ। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এই অভিযোগে নারীদের অযথা বেশি দায়ী করা হয়, কারণ গর্ভধারণই এর প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ধর্ষণ অথবা যৌন পাচারের শিকার নারীদেরও বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের জন্য অভিযুক্ত করা হতে পারে এবং তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হতে পারে।
সৌদি আরবে বিয়েবহির্ভূতভাবে জন্ম নেয়া শিশুরা জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়ার অধিকার বঞ্চিত হয়। এসব শিশুরা রাষ্ট্রীয় নথিভুক্ত না হওয়ায় তারা সব ধরনের মৌলিক অধিকার ও সেবা, যেমন চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। সেই সঙ্গে এসব শিশুরা অভিবাবকের সঙ্গে নির্ধারিত রাজ্যের বাইরে যেতে পারে না।
গার্ডিয়ানকে সাক্ষাতকার দেয়া ওই পাঁচ নারী জানিয়েছেন, তাদের গর্ভধারণ হয়েছিল সহকর্মী অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের সময়। এখন এরা সবাই সিঙ্গেল মাদারে পরিণত হয়েছেন। কিছু নারীর দাবি, তাদের সন্তানের বাবারা তাদের (নারী) ছেড়ে গেছে, কারণ বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণে গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন ওই সব পুরুষ।
কেনিয়া থেকে আসা অভিবাসী নারী ফাতিমা (ছদ্মনাম) সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, রিয়াদে তার বসতির কাছের হাসপাতালে তিনি প্রসব বেদনা নিয়ে ছুটে যান। এসব প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে হাসপাতালের কর্মীরা তাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছিলেন।
‘তারা বলেছিল যে, আমি যদি (প্রয়োজনীয়) নথি না আনতাম, তবে তারা আমাকে কারাগারে পাঠাত। প্রসব বেদনা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার ভয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমি ভান করলাম, যেন আমি হাসপাতালে হাঁটাহাঁটি করছি। তারপর, আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে আমার বাসায় ফিরে যাই।’
ফাতিমা তার বাসায় ফেরার পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ‘আমি নিজেই নাড়ি কেটে নবজাতককে পরিষ্কার করেছিলাম। আমার সন্তানকে পরিষ্কার করে একটি কম্বলে জড়িয়ে রাখি। এটি খুবই ভীতিকর ছিল, কিন্তু আমাকে তা করতেই হতো। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না।’
ফাতিমা বলেছিলেন যে, তিনি তার নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন, কারণ তিনি তার ওপর যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন। তিনি তার পাসপোর্টও কেড়ে নিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তবে গত দুই বছর ধরে সৌদি আরব ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কারণ জন্ম সনদ না থাকায় তার আট বছর বয়সী ছেলেটি স্কুলে যাওয়া থেকে বঞ্চিত।
এখানকার কর্তৃপক্ষ শিশু ও তাদের মায়েদের নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়,’ অভিযোগ করেন ফাতিমা। তিনি আরও জানান, এপ্রিল মাসে রিয়াদের মানফুহা এলাকায় অন্যান্য অভিবাসী মায়েদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে তারা একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন, যেখানে তারা যানচলাচল বন্ধ করেন এবং দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেন। যদিও সৌদিতে যেকোন ধরনের প্রতিবাদ অবৈধ এবং এর জন্য কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
‘আমরা চাই আমাদের মতো চরম বঞ্চিত মায়েদের সন্তানরা স্কুলে যাক। তারা তাদের শিশু-শিক্ষার অনেক কিছু থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তবে আমাদের শিশুরা এই সুযোগটি চিরতরে হারাচ্ছে।’
অভিবাসীর অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উপসাগরীয় দেশগুলোতে বিয়েবহির্ভূত এবং অনৈতিকভাবে জন্মগ্রহণ করা রাষ্ট্র পরিচয় হীন শিশুর সংখ্যা হাজার হাজার হতে পারে। তারা বলেন, জন্মপরিস্থিতি যাই হোক না কেন, প্রতিটি শিশুরই তাদের পরিচয় ও মানব সন্তান হিসেবে অধিকার রয়েছে।
সাক্ষাৎকার দেয়া নারীরা জানিয়েছেন, তারা সৌদি আরব ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের সন্তানদের সুস্থ এবং খাদ্যমান সমৃদ্ধ খাবার দিতে সংগ্রাম করছেন। তাদের একজন লিসা বলেন, ‘আমি মুদি দোকান থেকে শাক-সবজি এবং অবিক্রীত রুটি ও দুধ (ভিক্ষা) চাইতে বাধ্য হই আমার সন্তানের মুখে খাবার দেয়ার জন্য।’
সাক্ষাৎকার দেয়া সিঙ্গেল মায়েরা জানিয়েছেন, গত দুই বছরে তারা সৌদি আরব ছাড়ার জন্য সহায়তা পেতে বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেনিয়ার দূতাবাস রাষ্ট্রহীন সন্তানের মায়েদের প্রস্থান-ভিসা (ডিপার্টচার ভিসা) প্রক্রিয়াকরণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
‘কেনিয়ার দূতাবাসের কর্মীরা বলেন আমরা যৌনকর্মী,’ অভিযোগ করেনন ক্রিস্টিন। তিনি একজন কেনিয়ার নাগরিক এবং একজন মা যার রাষ্ট্রহীন ছোট্ট শিশু রয়েছে। ‘তারা ভুলে যায় যে এই শিশুদের অনেকেই তাদের মায়েদের কর্মস্থলের নিয়োগকর্তা বা চালকের ধর্ষণের শিকার মায়েদের সন্তান। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং অমানবিক।
কেনিয়ার দূতাবাস জানিয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে সিঙ্গেল মা ও তাদের সন্তানদের ডিএনএ-র নমুনা নেয়া হয়েছে এবং পরীক্ষার ফলাফল এখন প্রক্রিয়াকরণাধীন। রয়েছে। সৌদি আরবে কেনিয়ার রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রুওয়াঙ্গে, সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দূতাবাসের কর্মীরা ভুলভাবে কিছু মাকে জানিয়েছেন, তাদের ডিএনএ সন্তানের সঙ্গে মেলে না।
‘দূতাবাস নিশ্চিত করতে চায়, এটি কেনিয়ার অভিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকের সর্বোচ্চ সম্মান রক্ষায় যত্ন এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে, নাবালকদের সঙ্গে জড়িত এই সংবেদনশীল খবর এবং শিশু পাচারের অন্তর্নিহিত ঝুঁকি বিবেচনায়, দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত কেনিয়ান মায়েদের সহায়তা করেছে। সেই সঙ্গে দু’দেশের প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী এই সহায়তা অব্যাহত রেখেছে,’ বলেছেন রুওয়াঙ্গে। সৌদি সরকারকে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তাদের জবাব পাওয়া যায়নি।
পূর্বকোণ/আরআর