গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে এবং আগস্টের শুরুতে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করার পর বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের নেতৃত্বে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং এতে সুশীল সমাজের নেতারা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অভিজ্ঞতার আলোকে সামাজিক সংহতি তৈরি করতে এবং দেশের নিপীড়িত অতীতের একটি অতি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলপূর্বক গুম ও নির্যাতনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ভেঙে দিতে পারেন এবং সুশীল সমাজের প্রতি সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য এনজিও সংক্রান্ত অধিদপ্তরের সংস্কার করতে পারেন। অথবা বিদেশি অনুদান আইন সংশোধন করতে পারেন, যা আন্তর্জাতিক তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে।
ড. ইউনূসের দ্রুত কাজ করা উচিত। কারণ ইতিহাস আমাদের বলে যে, সুযোগের মুহূর্তগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী সরকার অপসারণের পর গণতান্ত্রিক কাঠামো দ্রুত প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতান্ত্রিক কাঠামো অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নাও হতে পারে। পটপরিবর্তনের এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। দেশের কর্তৃত্ববাদী শক্তি শাসক বনে যেতে পারে।
অভিজাতদের কালো থাবার মুখে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কীভাবে অটল থাকতে পারে তার একটি উদাহরণ চিলি। শাসকবাহিনী থেকে উল্লেখযোগ্য দমনপীড়ন সত্ত্বেও ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় বিক্ষোভ চিলিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবসর ভাতাসহ একাধিক সংস্কারের দিকে পরিচালিত করেছিল।
গুয়াতেমালাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে পূর্ববর্তী সরকারের দ্বারা বারবার বাধা পাওয়া সত্ত্বেও জানুয়ারিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ সম্ভব হয়েছিল। এই উভয় ক্ষেত্রেই সুশীল সমাজের দলগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এই উদাহরণগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া, যেখানে নাগরিকসমাজ কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সুদানের কথা। ২০১৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অনেক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য একটি প্রাথমিক অভ্যুত্থান হয়। কারণ দেশটিতে কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসকরা সুশীল সমাজের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। ফলে দেশটির শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের জন্য প্রতিবাদ করা সাংবাদিক, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীসহ ভিন্নমতের মানুষদের ওপর দমনপীড়ন চালায়। এখনও নীরবে চলছে এমন ঘটনা।
ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ইথিওপিয়ার শান্তিচুক্তির জন্য ২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয়নি। পরে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল ইথিওপিয়ায়।
গণঅভ্যুত্থানের পরও যদি ইউনূস সরকার সুশীল সমাজকে রাষ্ট্র সংস্কারে অংশগ্রহণ করাতে ব্যর্থ হন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল করা সম্ভব না হয়, তাহলে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তবে এমনই হতে পারে, তা নয়। ঘটতে পারে ভিন্ন কিছু। সাধারণত গণঅভ্যুত্থানের পরে গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলো দৃঢ় বা ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু এটি ব্যাপক এবং বাস্তবধর্মীও হতে পারে।
গণবিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এটি একটি উদাহরণ হতে পারে। পুরোটা না হলেও গোতাবায়ার পদত্যাগের পর শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছিল। গতমাসে অনুরা কুমারা দেসানায়েকে আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। গুয়াতেমালায় পুরনো শাসনের দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর রোধ করার জন্য বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জানুয়ারিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শপথগ্রহণ করেন। সেখানেও বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা থাকতে পারে।
যাইহোক, ড. ইউনূসের সরকারের এমন ঘটনাগুলো থেকেও শিক্ষা নেওয়া উচিত, যেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো শক্তিশালী স্বৈরাচারীদের ক্ষমতা পতনে সাহায্য করলেও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত, গণতন্ত্রবিরোধী নেতাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
যদিও কোন নতুন সরকারের কাছ থেকে সমস্ত ক্ষেত্রে রাতারাতি সন্তোষজনক সংস্কার এবং একটি নিখুঁত গণতন্ত্র (বিশেষ করে কয়েক দশকের স্বৈরাচারী শাসনের পর) আশা করা অবাস্তব, কিন্তু বিশ্বজুড়ে অগণিত উদাহরণ দেখায় যে, দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্ববাদী নেতাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের উপর একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব; যতক্ষণ নতুন নেতৃত্ব দৃঢ় সংকল্পের সাথে কাজ করে, সুশীল সমাজের সাথে সংলাপ চালিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক পথে থাকে।
যদি অধ্যাপক ইউনূস অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেন এবং বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন, তাহলে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার মতো অনুপ্রেরণাদায়ী অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেন, যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে অবদমিত। ড. ইউনূস যদি একটি সফল বিপ্লবোত্তর উত্তরণের উদাহরণ সৃষ্টি করতে চান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত।
সূত্র: আল জাজিরা