আর মাত্র ১৭ দিন বাকি। ৫ নভেম্বর হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এরইমধ্যে প্রচার-প্রচারণায় জমে ওঠেছে এই নির্বাচন। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প চষে বেড়াচ্ছেন রাজ্যগুলোতে। বিশেষ করে সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে ভোট টানতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দুই প্রার্থী।
আমেরিকার নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের অনুকূলে ভোট দিয়ে থাকে। কিন্তু হাতে গোনা কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যে রাজ্যগুলোর ভোট, প্রার্থীদের কারণে যে কোন শিবিরে যেতে পারে। আর এই দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয় পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি।
এবার এধরনের সাতটি অঙ্গরাজ্য হচ্ছে :
জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, মিশিগান, নেভাদা, উত্তর ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন। এসব রাজ্যে সাম্প্রতিক জরিপে কমলা হ্যারিস কিছুটা এগিয়ে থাকলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত রাজ্যের ভোটের ফলাফলের ওপর ট্রাম্প ও কমলার ভাগ্য নির্ভর করছে। অপরদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে নির্বাচনে মুসলিম ও ইহুদি ভোট গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
জর্জিয়ায় আগাম ভোট শুরু :
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সুইং স্টেট জর্জিয়ায় আগাম ভোট শুরু হয়েছে। ২ লাখ ৫২ হাজার ভোটদাতা আর্লি ব্যালটের সুবিধা নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আগাম ভোট ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে এদিনে এক লাখ ৩৬ হাজার ভোটদাতা আগাম ভোট দিয়েছিলেন অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজন আগাম ভোট দিয়েছেন। মার্কিন নির্বাচনে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটের মধ্যে একটি হলো জর্জিয়া। এই রাজ্যের ১৬টি ইলেক্টোরাল ভোট যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বাছাইয়ের চাবিকাঠি হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। জর্জিয়ায় দেশের সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার আছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে এই কৃষ্ণাঙ্গ ভোটের জোরেই জয় পেয়েছিলেন জো বাইডেন। এবারের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসও কৃষ্ণাঙ্গ ভোট দলে টানার চেষ্টা করছেন। এই শ্রেণির মধ্যে তিনি স্পষ্টতই জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন।
এ সপ্তাহে যে কেবল জর্জিয়াতেই আগাম ভোট হবে তা নয়, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্য নর্থ ক্যারোলিনাতেও আগাম ভোট হবে। এসব রাজ্যের আগে গত ২০ সেপ্টেম্বরে প্রথম আগাম ভোট গ্রহণ শুরু হয় ভার্জিনিয়া, মিনেসোটা এবং সাউথ ডাকোটায়। ৫ নভেম্বরে দেশের বাদবাকী অংশে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে অক্টোবরের মধ্যে আগাম ভোট হয়ে যাবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নেব্রাস্কা এবং ভারমন্ট পর্যন্ত।
সর্বশেষ ১২ নির্বাচনের মধ্যে ৮ বারই জর্জিয়ার বিজয়ীরা হোয়াইট হাউসের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন। আবার ১৯৯২ সালে বিল ক্লিনটনের পরের ছয় নির্বাচনেই জর্জিয়াতে জিতেছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী। তিন দশক পরে ২০২০ সালে এসে এই রাজ্যে প্রথম ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে জেতেন জো বাইডেন।
মুসলিম ও ইহুদি ভোট ফ্যাক্টর :
ইসরায়েলের তেলআবিবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত। একারণে এবারের নির্বাচনে মুসলিম ও ইহুদি ভোটারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং দুই প্রার্থী তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ার মুসলিম ও ইহুদি ভোট। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ার সম্ভাব্য পথ হলো এই দুই অঙ্গরাজ্যে ও উইসকনসিনে ভোট নেওয়া। উইসকনসিনে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও, কমলার নজর এখন মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায়।
মিশিগানে প্রায় দুই লাখ আরব ও মুসলিম ভোটার রয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি হামলার ফলে অনেক মুসলিম ভোটার কমলার পক্ষে ভোট দেবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, মিশিগানে ১ লাখ ২০ হাজার ইহুদি ভোটার আছেন, যাদের অধিকাংশই ডেমোক্রেটদের সমর্থক। নতুন জরিপ অনুযায়ী, ৭১ শতাংশ ইহুদি ভোটার কমলা ও ডেমোক্রেটদের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন, যখন মাত্র ২৬ শতাংশ ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। যদিও ট্রাম্পের প্রচার শিবির এই জরিপকে অযৌক্তিক দাবি করেছে। অন্যদিকে, রিপাবলিকান জুইশ কোয়ালিশনের জরিপে দেখা গেছে, ইহুদি ভোটারদের অর্ধেকই ট্রাম্পের সমর্থক।
ইহুদিদের ব্যাপারে অবশ্য কমলার প্রচার শিবির অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কমলার স্বামী ডাগ এমহফ একজন ইহুদি, যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি-বিদ্বেষ ঠেকাতে তিনি একটি জনপ্রিয় রণকৌশল প্রণয়ন করেছেন। নিজের স্বামীকে ইহুদি ভোট শিকারে কমলা কাজে লাগাচ্ছেন। গত তিনটি নির্বাচনে সারা দেশে ইহুদিদের প্রায় ৭০ শতাংশ ডেমোক্রেটদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিলেও আরব ও মুসলিম ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে কমলা গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছেন, ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করেছেন। ফলে ভোট নিয়ে মুসলিম ও ইহুদি কমিউনিটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
নির্বাচনের আগে ইরানে ‘হামলা’ :
সম্প্রতি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাব দিতে দেশটিতে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে ইসরায়েল। তবে কবে বা কীভাবে হামলা হবে সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। বুধবার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এ তথ্য জানিয়েছে। এ ব্যাপারে সূত্রটি জানায়, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছেন, তেল ও পারমাণবিক স্থাপনার পরিবর্তে বরং ইরানের সামরিক স্থাপনায় সীমিত পরিসরে পাল্টা হামলা চালানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন আরও জানিয়েছে, ইসরায়েল আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ইরানে হামলা চালাতে পারে। চলতি মাসেই এ হামলা হতে পারে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। গত সপ্তাহে ইউএস প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে টেলিফোন আলাপ সম্পর্কে অবহিত একজন কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন যে ইরানে হামলার পরিকল্পনা এমনভাবে করা হবে যাতে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব না পড়ে।
ট্রাম্প শিবিরে সর্বোচ্চ ৭ কোটি ডলার দিলেন মাস্ক :
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাম্পেইনের জন্য প্রায় সাড়ে সাত কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। মঙ্গলবার প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে দেখা যায়, গত তিন মাসে ট্রাম্পপন্থি ‘ব্যয় গোষ্ঠীকে’ (স্পেন্ডিং গ্রুপ) এই পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন তিনি। দেশটির নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে ‘আমেরিকা পিএসি’ প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ট্রাম্পের প্রচারণার সমর্থনের জন্য কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে গঠন করেছেন মাস্ক। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে কাজ করে থাকে আমেরিকা পিএসি।
নির্বাচনে থার্ড পার্টি :
ট্রাম্প-কমলা ছাড়াও এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত নাম জিল স্টেইন। তৃতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউজের জন্য লড়ছেন গ্রিন পার্টির এই প্রার্থী। ২০১২ ও ২০১৬ সালের ফলাফলে চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন এই পরিবেশ অধিকারকর্মী। এবারের নির্বাচনে স্যুইং স্টেটগুলোতে ট্রাম্প-কমালার পাশাপাশি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন জিল স্টেইন।
ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানদের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চেজ অলিভার। লিবারেটেরিয়ান পার্টির হয়ে এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। এছাড়াও, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন ৭১ বছর বয়সী স্বতন্ত্র করনেল ওয়েস্ট।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক
পূর্বকোণ/ইব