[বিদেশের তুচ্ছতাছিল্যের জবাব দিয়েছেন সপাটে! ভারত সেরা, প্রমাণ করেছেন বারবার, নানা কারণে রতন টাটার কথা কিছুতেই ভোলা যাবেনা, মানুষের মনে থেকে যাবেন চিরকাল]
এক শিল্প প্রতিষ্ঠানে মানবিকতার সঞ্চারও যে করা যায়, তার একমাত্র দৃষ্টান্ত বোধহয় তিনিই। ছয় দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বর্ণময় কর্মজীবনে সারা বিশ্বের কাছে প্রচেষ্টা, সাফল্য এবং সহানুভূতির নাম হয়ে থাকবেন রতন টাটা। শুধুমাত্র দাপুটে শিল্পপতি হিসেবে নন, তিনি এমন এক কর্মযোগী যিনি তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনায় বহু মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁর অবদানই টাটা গ্রæপকে এক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার দেশের শিল্পের পটভূমিকেও একটা আকার দিয়েছে তার অবদান। এমন এক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নিঃসন্দেহেই কোটি ভারতীয়ের মনে এক শূন্যস্থান তৈরি করেছে।
রতন টাটাকে ভারতীয় শিল্পের জনকও বলা যেতে পারে। ১০০টি দেশে ১০টি ক্ষেত্রে ৩০টির মতো সংস্থা রয়েছে টাটার। নুন থেকে আইটি, গাড়ি থেকে স্টিল, নানা ক্ষেত্রে রয়েছে টাটার পদচিহ্ন। টাটা গোষ্ঠীর সব সংস্থা মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি কর্মী কাজ করেন। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে টাটা গোষ্ঠীর সব সংস্থার সম্মিলিত আয় ছিল ১৬৫ বিলিয়ন ডলার। টাটা গোষ্ঠীর ওয়েবসাইট অনুযায়ী, টাটা এন্টারপ্রাইজের ২৬টি সংস্থা তালিকাভুক্ত রয়েছে শেয়ার বাজারে। এই সংস্থাগুলির সম্মিলিত মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন হল ৩৬৫ বিলিয়ন ডলার। তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, আইটি ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর অধীনে থাকা সংস্থাগুলি হল- টিসিএস, টাটা এলএক্সসি, টাটা টেকনোলজিস, টাটা ডিজিটাল। এছাড়া টাটা গোষ্ঠীর অন্যতম পুরনো সংস্থা হল টাটা স্টিল।
গাড়ি ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি হল টাটা মোটরস, জ্যাগুয়ার ল্যান্ড রোভার, টাটা অটোকম্প সিস্টেম। এদিকে কনজিউমার প্রোডাক্ট ক্ষেত্রে টাটার সংস্থাগুলি হল – টাটা কেমিক্যাব, টাটা কনজিউমার প্রোডাক্ট, টাইটান কোম্পনি, ভোল্টাস, ইনফিনিটি রিটেল, ট্রেন্ট। আর ইনফ্রাস্ট্রাকচর ক্ষেত্রে টাটার সংস্থাগুলি হল- টাটা পাওয়ার, টাটা প্রোজেক্ট, টাটা রিয়েলটি, টাটা হাউজিং, টাটা কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার। এদিকে ফিন্যান্সিয়াল ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি হল- টাটা ক্যাপিটাল, টাটা এআইএ লাইফ, টাটা এআইজি, টাটা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। এদিকে অ্যারোস্পেস ক্ষেত্রে তাদের সংস্থা হল টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেম। ভ্রমণ ও পর্যটন ক্ষেত্রে টাটার সংস্থাগুলি হল- টাটা এসআইএ এয়ারলাইন্স (ভিস্তারা), এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান হোটেল (তাজ হোটেল চেইন)।
এদিকে টেলিকম ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি হল- টাটা কমিউনিকেশনস, টাটা প্লে, টাটা টেলিসার্ভিসেস। এছাড়াও টাটার আরও সংস্থাগুলি হল টাটা ইন্টারন্যাশনাল, টাটা ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা ইলেকট্রনিকস। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টাটা গোষ্ঠীর সংস্থা হল- টাটা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন। ১৯৬২ সালে টাটা স্টিল বিভাগে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এর ৯ বছর পর তিনি ন্যাশনাল রেডিয়ো অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি লিমিটেডের ডিরেক্টর-ইন-চার্জ হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে জেআরডি টাটা পদত্যাগ করলে রতন টাটা তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন।
পদে থাকাকালীনই রতন টাটা নিয়ম বানান, টাটা সন্স-এর চেয়ারম্যান পদে ৭৫ বছর বয়েসের ঊর্ধে কেউ বসবেন না। সেই নিয়ম অনুসরণ করেই তিনি ২০১২ সালে অবসর নেন। ২০১২ সালের পর টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এমেরিটাস পদে ছিলেন রতন টাটা।
অকৃতদার ও লাজুক স্বভাবের রতন টাটা আন্তর্জাতিক মহলে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভারতীয় ব্যবসায়িক নেতাদের একজন। দুই দশকের বেশি সময় টাটা শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালে ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেন রতন টাটা। তাঁর হাত ধরেই টাটা শিল্পগোষ্ঠীর রাজস্বের পরিমাণ বহু গুণ বেড়ে ২০১১-১২ সালে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। ঝুঁকি নিয়েছেন বারবার ভারতের যে প্রান্তেই যান না কেন, একটি ব্র্যান্ড সবখানে চোখে পড়বে। সেটি টাটা। এমনকি ভারতজুড়ে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি টাটার কোনো পণ্য ব্যবহার করেননি। টাটার সেবা নেননি। লবণ থেকে ইস্পাত, মোটর- টাটা খুঁজে পাবেন সবখানেই। বলা যায়, টাটা হলো ভারতে সবখানে ছড়িয়ে পড়া ব্র্যান্ড।
তবে এ যাত্রা সহজ ছিল না। নানা প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও টাটাকে এগিয়ে নিতে রতন টাটা বড় ধরনের সাহস দেখিয়েছেন। যদিও বড় ধরনের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সীমিত রেখেছিলেন রতন টাটা। তিনি এমন এক সময়ে টাটা শিল্পগোষ্ঠীতে পুনর্গঠন শুরু করেন, যখন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হাঁটছিল। তাঁর হাত ধরে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। একই সময়ে বিশ্বায়নের গতিধারাকে নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নতুন শতকের শুরু থেকে টাটা শিল্পগোষ্ঠী বড় অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এর মধ্যে ৪৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারে টেটলি, ১ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে কোরাস, ২৩০ কোটি ডলারে জাগুয়ার ল্যান্ডরোভার, বার্নার মন্ড, জেনারেল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টস এবং ১০ কোটি ২০ লাখ ডলারে দাইয়ু অধিগ্রহণের ঘটনাও রয়েছে।
এসব কার্যক্রম রতন টাটার হাত ধরে এই শিল্পগোষ্ঠীকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই এগিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে পরিধি বাড়তে বাড়তে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে শতাধিক দেশে। ভারতের শিল্প খাতে তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ ঘটায় টাটা। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে টাটাকে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কৃতিত্ব অনেকটাই রতন টাটার। রতন টাটা বিশ্বজুড়ে হোটেল, রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি সরবরাহ খাতে ব্যবসা বাড়ান। একপর্যায়ে রতন টাটা এয়ার ইন্ডিয়া কিনে নেন। মূলত এ উদ্যোগকে পূর্বপুরুষদের সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। কেননা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩২ সালে রতন টাটার চাচা ও পরামর্শদাতা জেআরডি টাটার হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
ব্যবসার মধ্য দিয়ে লাভ করার চেয়েও বাড়তি কিছু ভাবতেন তিনি নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিলেন। ২০২১ সালে আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ তালিকায় রতন টাটা ৪৩৩তম অবস্থানে ছিলেন। সম্পদের অনেকটাই দাতব্য কাজে দান করেছেন। রতন টাটার হাত ধরে এগিয়ে চলা টাটা ট্রাস্ট ভারতের অন্যতম বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটি। প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং টেকসই জীবনযাপন খাতের প্রকল্পে সহায়তা করা হয় টাটা ট্রাস্ট থেকে। করোনা মহামারির সময়ও ৫০০ কোটি রুপি দান করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন রতন টাটা।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে একটি নির্বাহী কেন্দ্র গড়ে তুলতে পাঁচ কোটি ডলার দান করেছিলেন রতন টাটা। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। মুম্বাইয়ে প্রাণঘাতী ২৬/১১ হামলার পর রতন টাটা ‘তাজ পাবলিক সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের অর্থ হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনে ব্যয় করা হয়। ৫০টির বেশি স্টার্টআপে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন রতন টাটা। তিনি কুকুর পছন্দ করতেন। টাটা সন্সের বৈশ্বিক সদর দপ্তরে (বোম্বে হাউস নামে পরিচিত) বেশ কিছু রাস্তার কুকুর আশ্রয় পেয়েছিল। তিনি কুকুরগুলোর খোঁজখবর রাখতেন।
২০২১ সালে রতন টাটার প্রশংসায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রীতিমতো ভেসে যায়। ওই সময় তিনি অসুস্থ থাকা সাবেক একজন কর্মীকে দেখতে মুম্বাই থেকে পুনে অবধি ছুটে গিয়েছিলেন। জীবনভর এমনই নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন এই ধনকুবের। স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০০০ সালে ভারত সরকার রতন টাটাকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৮ সালে পান পদ্মবিভূষণ। দুটিই ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকের তালিকায় রয়েছে। ভারত ও ভারতের বাইরের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানজনক ডিগ্রি দিয়েছে। তবে রতন টাটা তাঁর দীর্ঘ জীবনে যেটা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন, তা সাধারণ মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা।
ভারতের এই নন্দিত শিল্পপতি গত বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে প্রায় ৮৭ বছর বয়সে (জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৭) ৩৮০০ কোটির সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। তার উত্তরসূরি কে হবেন প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। [ তথ্যসূত্র : এএফপি, পিটিআই, হিন্দুস্তান টাইমস]
পূর্বকোণ/ইব