ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মার্কিন ছাত্রদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ নিশ্চেতভাবেই একটি উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক ঘটনা। এর পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক মাধ্যমের সক্রিয়তা এবং মানবাধিকার বিষয়ক বর্ধিত সচেতনতাসহ অসংখ্য কারণ রয়েছে। এর সাথে দারুণ মিল রয়েছে ১৯৬০’র সেই নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও ভিয়েতনাম-যুদ্ধবিরোধী ছাত্র-বিক্ষোভের।
গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান এই বিক্ষোভ সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো ক’টি প্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস নেওয়া আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বিক্ষোভ সামাল দিতে গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি দেয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে গিয়ে বিক্ষোভকারী কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেফতার করে, যা সারা বিশ্বেই বেশ আলোচিত হয়। শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের ঘটনার পর বিক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত সোমবার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভকারী প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিক্ষোভ ব্যাপকাকার পায়। যুক্তরাষ্ট্রের আরো যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, বার্কলে কলেজ এবং এমারসন কলেজ।
এখানে বিক্ষোভ নিয়ে এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর একটা নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা তুলে ধরা হলো।
বিশ্বব্যাপী আক্রোশ
বিক্ষোভটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরে অন্য মহাদেশ জুড়েও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বৈশ্বিক সংহতি নিশ্চিতআবেই ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার সর্বজনীনতার কথাই আমাদের স্মরন করিয়ে দেয়।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির সক্রিয়তা
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি ছাত্রদের মধ্যে ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন জোগাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। #FreePalestine Ges #SaveSheikhJarrah-এর মত হ্যাশট্যাগগুলি বিশ্বব্যাপী তথ্য প্রচার এবং কর্মীদের সংগঠিত করতে ব্যাপক সহায়তা করেছে।
সাম্প্রদায়িক সংহতি
বিক্ষোভগুলি ঐতিহ্যগত সীমানা অতিক্রম করেছে। ছাত্ররা ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে অন্যান্য সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলন, যেমন- ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এবং ‘আদিবাসী অধিকার আন্দোলনে’র সাথে একত্রিত করেছে। ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সংহতির আবেদনময়তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্যাম্পাস অ্যাক্টিভিজম
বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলি ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি সক্রিয়তার কেন্দ্রস্থল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ছাত্র-সংগঠন, একাডেমিক বিভাগ এবং অনুষদ সদস্যরা ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং বর্ণবাদ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে চাপ দেওয়ার জন্য সমাবেশ, শিক্ষাদানে বিরতিসহ নানা আয়োজন করেছে। বিক্ষোভ বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে শান্ত রাখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের ওপর দিনদিন চাপ বাড়ছে। যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ এবং তর্কবিতর্কের চর্চাও বাড়ছে। উভয় পক্ষের শিক্ষার্থীরাই দাবি করেছেন যে, সা¤প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইহুদিবিদ্বেষ এবং ইসলামভীতি- দুটোই বেড়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং বিতর্ক
তবে এসব প্রতিবাদ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং বিতর্কও সেগুলোর পিছু ছাড়েনি। সেন্সরশিপ, ভীতি প্রদর্শন এবং ফিলিস্তিনপন্থী সক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক ঘটনা দেখা গেছে ক্যাম্পাসগুলোয়। এর সাথে রাজনীতিকে যুক্ত করার ব্যাপক প্রয়াসও লক্ষ্য করা গেছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
সরকারগুলি বিভিন্ন মাত্রার সমর্থন বা নিন্দাসহ এসব প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যদিও কিছু প্রশাসন ফিলিস্তিনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং ছাত্রদের প্রতিবাদ করার অধিকার রক্ষা করেছে, অন্যরা ভিন্নমত দমন করতে চেয়েছে এবং ইহুদি-বিদ্বেষের সাথে ইসরায়েলের সমালোচনাকে এক করে ফেলেছে। নীতির উপর প্রভাব ছাত্র বিক্ষোভ স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট, বিতাড়ন এবং নিষেধাজ্ঞার আহবান গতি পেয়েছে। কর্পোরেশন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারগুলিকে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সংস্থাগুলির সাথে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করেছে এটা।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
ছাত্র বিক্ষোভের টেকসই প্রকৃতি তরুণদের মধ্যে ন্যায়বিচার ও সংহতির প্রতি তাদের গভীর ও বদ্ধমূল অঙ্গীকারের জানান দেয়। এই ভবিষ্যতের নেতা, প্রভাববিস্তারক এবং নীতিনির্ধারক শিক্ষার্থীরা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা ফিলিস্তিনি সংগ্রামের গতিপথকে সার্থক রূপ দিতে এবং এই অঞ্চলে শান্তি, ন্যায়বিচার এবং সমতার চাকাকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত।
উপসংহারে বলা যায়, ফিলিস্তিনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে এই ছাত্র বিক্ষোভ আসলে একটি বহুমুখী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে- যেটা ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বব্যাপী সংহতি, তৃণমূল আন্দোলনের ক্ষমতা এবং অন্যায় ও নিপীড়নের মোকাবিলায় সম্মিলিত পদক্ষেপের অপরিহার্যতাকে তুলে ধরেছে।