কয়েক ডজন সংবাদ সংস্থার ৭৫০ টিরও বেশি সাংবাদিক বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন যাতে গাজায় ইসরায়েলের সাংবাদিকদের হত্যার নিন্দা এবং যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়ার কভারেজের সমালোচনা করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, নিউজরুমগুলি অমানবিক বক্তব্যাদি প্রচারের জন্য দায়ী- যা ‘ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল’কে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য নির্লজ্জভাবে কাজ করে চলেছে। চিঠিতে রয়টার্স, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, বোস্টন গ্লোব, ওয়াশিংটন পোস্টেও মতো বিখ্যাত সাংবাদিকগণ স্বাক্ষর করেছেন। তাঁরা বেশির ভাগ মার্কিন মুদ্রণ-সম্প্রচারমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সংবাদের পরিবেশন দেখে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সিএনএনের ‘যুদ্ধে ইসরায়েল’ প্রতিপাদ্যের সংবাদে গাজাকে দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়ে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঢালাওভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা সংঘাত নিয়ে ইসরায়েলের বয়ান ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলি নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের হত্যার ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ধরছে। ইরাকে হামলার প্রেক্ষাপট ফাঁদা ও ৯/১১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পর তাঁরা এত বিচার-বিবেচনা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা আর লক্ষ করেননি। কাণ্ডজ্ঞান ও ন্যূনতম পেশাগত সততার কথা বাদ দিলেও শুধু অভিজ্ঞতা থেকেই সবার বোঝা উচিত, এ জাতীয় উত্তেজক ও অমানবিক সংবাদ প্রচার কতটা বিপজ্জনক। এর আগে নানা পেশার ‘বিশেসজনও’ লিখেছেন, তারা আশা করেন, অন্যরাও তাঁদের মতো এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন যে বিশেষ করে ক্ষমতা প্রদর্শন ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার সবচেয়ে পরিশীলিত রূপ হলো সন্দেহপ্রবণ হওয়া, সংকোচহীনভাবে সমালোচনা করে যাওয়া। এভাবেই সাংবাদিকতা চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে তার প্রধান গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করে। মানুষকে সঠিক জ্ঞান ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বুদ্ধিদীপ্ত নীতি নির্ধারণে সক্ষম করে তোলে।
এই ইস্যুতে দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ পরিবেশনের জ্ঞান ও উপায় দুটোই মার্কিন গণমাধ্যমের রয়েছে। গণমাধ্যমের অনেকেই ২০২২ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলের হত্যার তদন্ত করেছে। এই ঘটনার জেরে সবাই জানে, ইসরায়েলি সামরিক ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কতটা মিথ্যাশ্রয়ী হতে পারেন। গণমাধ্যমের সেই সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি আজ কোথায়, যখন এটাই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন?
সাংবাদিকতার জায়গা থেকে আজ কেন কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না? কেনই-বা গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রচারিত বানোয়াট-ভিত্তিহীন দাবিগুলোকে গণমাধ্যম প্রশ্নের মুখে ফেলছে না?
এটা অন্যদের মতো সাংবাদিকদের কাছেও বেশ স্পষ্ট যে ইসরায়েল সরকার গাজা উপত্যকায় গণহত্যাকে জায়েজ করতে পশ্চিমা জনমত গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এই ধারাবাহিকতায় গাজায় প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে এক হাজারের বেশি শিশু আছে।
ফিলিস্তিনিদের কোনো ধরনের ‘উসকানি’ দেওয়া হয়নি বলে একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখেছে।
এখানে সত্য হলো, শুধু ২০২৩ সালেই ইসরায়েল ৪৭ জন শিশুসহ ২৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
৭ অক্টোবরের আগে মার্কিন গণমাধ্যম কেন দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো ইসরায়েলি সহিংসতা-ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে প্রতিবেদন বা সমালোচনা করেননি। কেন দেখে মনে হচ্ছে যে গাজার যন্ত্রণা-দুর্ভোগ নথিভুক্ত করার মতো কোনো প্রতিবেদকই মার্কিন গণমাধ্যমের নেই। কেন ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা বা বয়ান পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো সদিচ্ছা মার্কিন গণমাধ্যমের নেই।
এসব নিয়ে বিচার-বিবেচনা করার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, ডামাডোল আরও না বাড়িয়ে অতি সত্বর এসব বন্ধ করা। চিঠিতে স্বাক্ষর করা সাংবাদিকগণ বেশি উদ্বেগ জানিয়েছেন- ইসরায়েলিরা তাদেও সহকর্মী সাংবাদিরদেরও নির্বিচারে হত্যা করছে। ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৯ ও সংবাদকর্মীকে ইসরায়েলিরা হত্যা করেছে। আসছে দিনগুলোতে আরও অনেক ফিলিস্তিনির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হবে বলে এ সাংবাদিকেরা ভয় পাচ্ছেন।
[সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট]