চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

কাউকে পেছনে না রেখে জি২০-কে সর্বশেষ পর্যায়ে আনয়ন

নরেন্দ্র মোদি

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ

‘বসুধৈব কুটুম্বকম’—শব্দ দুটি একটি গভীর দর্শনকে ধারণ করে। এর অর্থ, ‘বিশ্ব একটি পরিবার’। এটি একটি সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আমাদের একটি সর্বজনীন পরিবার হিসেবে দেশের সীমানা, ভাষা ও মতাদর্শগুলোকে অতিক্রম করে অগ্রগতি সাধন করতে উৎসাহিত করে। ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি চলাকালে এটি মানবকেন্দ্রিক অগ্রগতির একটি আহ্বানে পরিণত হয়েছে। এক পৃথিবী হিসেবে আমরা আমাদের গ্রহের প্রতিপালন করতে একত্রিত হচ্ছি। এক পরিবার হিসেবে আমরা পরস্পরকে উন্নতির সাধনায় সহায়তা করি এবং আমরা একসঙ্গে একটি সম্মিলিত ভবিষ্যৎ অভিমুখে অগ্রসর হই—এক ভবিষ্যৎ, যা এ আন্তঃসংযুক্ত সময়ে একটি অনস্বীকার্য সত্য।

অতিমারী-পরবর্তী বিশ্বের অবস্থা এর আগের থেকে অনেকখানিই ভিন্ন। অন্যান্য পরিবর্তনের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পরিবর্তন রয়েছে।

প্রথমত, একটি ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি হচ্ছে যে বিশ্বের জিডিপিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থানান্তরকরণ প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনে স্থিতিস্থাপকতা এবং নির্ভরযোগ্যতার গুরুত্বকে বিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে।

তৃতীয়ত, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে বহুপক্ষীয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্মিলিত আহ্বান।

আমাদের জি২০ প্রেসিডেন্সি এ পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে যখন আমরা ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে প্রেসিডেন্সি গ্রহণ করি, আমি লিখেছিলাম যে জি২০-এর মাধ্যমে মানসিকতার পরিবর্তনের অনুঘটন হওয়া উচিত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ, গ্লোবাল সাউথ ও আফ্রিকার প্রান্তিক আকাঙ্ক্ষাগুলোকে মূলধারায় নিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজন ছিল।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ১২৫টি দেশের অংশগ্রহণের সাক্ষী হওয়া দ্য ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট ছিল আমাদের প্রেসিডেন্সির অধীনে অন্যতম অগ্রণী একটি উদ্যোগ। গ্লোবাল সাউথ থেকে ইনপুট ও চিন্তাধারা অর্জন করার লক্ষ্যে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। অধিকন্তু, আমাদের প্রেসিডেন্সি শুধু আফ্রিকার দেশগুলো থেকে সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণ দেখেনি বরং আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি২০-এর স্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও জোর দিয়েছে।

একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের অর্থ, আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জুড়ে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলোর আন্তঃসংযুক্তি। এটি এজেন্ডা ২০৩০-এর মাঝামাঝি একটি বছর এবং অনেকেই অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছেন যে এসডিজির অগ্রগতি পথভ্রষ্ট হয়েছে। এসডিজির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে নেয়া জি২০ ২০২৩ অ্যাকশন প্ল্যান জোটটির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভূমিকা রাখবে।

ভারতে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন প্রাচীনকাল থেকেই একটি আদর্শ এবং আমরা এমনকি আধুনিক সময়েও জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ডে আমাদের অংশে অবদান রেখেছি।

গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ডকে অবশ্যই একটি পরিপূরক সাধনা হতে হবে। জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ডের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা অবশ্যই জলবায়ুসংক্রান্ত অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি যে কী করা উচিত নয় সেটার একটি সম্পূর্ণরূপে সীমাবদ্ধ মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কী করণীয়, সেটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আরো গঠনমূলক মনোভাবের দিকে যেতে হবে।

একটি টেকসই ও স্থিতিস্থাপক নীল অর্থনীতির জন্য চেন্নাই হাই-লেভেল প্রিন্সিপলগুলো আমাদের মহাসাগরগুলোকে সুস্থ রাখার ব্যাপারে মনোযোগ নিবদ্ধ করে।

আমাদের প্রেসিডেন্সি চলাকালে একটি গ্রিন হাইড্রোজেন ইনোভেশন সেন্টারসহ ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন হাইড্রোজেনের জন্য একটি গ্লোবাল ইকোসিস্টেমের উদ্ভব হবে।

২০১৫ সালে আমরা ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্সের সূচনা করেছি। এখন গ্লোবাল বায়োফুয়েলস অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে আমরা একটি সার্কুলার ইকোনমির সুবিধার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্বালানি রূপান্তরকরণে সক্ষম করতে বিশ্বকে সমর্থন করব।

জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ডের গণতন্ত্রীকরণ এ আন্দোলনকে গতি দেয়ার সর্বোত্তম উপায়। ব্যক্তিমানুষ ঠিক যেভাবে তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর ভিত্তি করে দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, একইভাবে তারা গ্রহের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে জীবনধারাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যোগব্যায়াম যেমন সুস্থতার জন্য একটি বিশ্বব্যাপী গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে, তেমনই আমরা টেকসই পরিবেশের জন্য লাইফস্টাইল (লাইফ) দিয়ে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। মিলেটস বা শ্রী অন্ন জলবায়ুসচেতন কৃষি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এতে সহায়তা করতে পারে। আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষে আমরা মিলেটকে বিশ্বব্যাপী রসনায় নিয়ে গেছি। খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিবিষয়ক ডেকান হাই লেভেল প্রিন্সিপলসও এক্ষেত্রে সহায়ক।

প্রযুক্তি হলো রূপান্তরকারী, কিন্তু এটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলকও করতে হবে। অতীতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুফল সমাজের সব অংশকে সমানভাবে উপকৃত করেনি। গত কয়েক বছরে ভারত দেখিয়েছে, কীভাবে বৈষম্যকে প্রসারিত করার পরিবর্তে সংকীর্ণ করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, সারা বিশ্বে যে কোটি কোটি মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে বা ডিজিটাল আইডেন্টিটির অভাবে রয়েছে, তাদের ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারের (ডিপিআই) মাধ্যমে আর্থিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ডিপিআই ব্যবহার করে আমরা যে সমাধানগুলো প্রদান করেছি তা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত৷ এখন। জি২০-এর মাধ্যমে আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির শক্তিকে উন্মুক্ত করতে ডিপিআইয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, নির্মাণ ও পরিমাপ করতে সাহায্য করব।

ভারত যে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতি, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। আমাদের সহজ, পরিমাপযোগ্য ও টেকসই সমাধানগুলো দুর্বল ও প্রান্তিকদেরকে আমাদের উন্নয়নের গল্পে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম করে তুলেছে। মহাকাশ থেকে খেলাধুলা, অর্থনীতি থেকে উদ্যোক্তা, ভারতীয় নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা নারী উন্নয়নের আখ্যানকে নারী নেতৃত্বাধীন উন্নয়নে রূপান্তর করেছেন। আমাদের জি২০ প্রেসিডেন্সি শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ব্যবধান হ্রাস করে এবং নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের একটি বৃহত্তর ভূমিকার জন্য সক্ষম করে তোলার মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজনের ব্যাপারে সেতুবন্ধ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে।

ভারতের জন্য জি২০ প্রেসিডেন্সি নিছক উচ্চস্তরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নয়। গণতন্ত্রের জননী ও বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবে আমরা বিশ্বের কাছে এ অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দিয়েছি।

বর্তমানে মানদণ্ড অনুসারে যেকোনো বিষয় সম্পাদন করা একটি গুণ যা ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জি২০ প্রেসিডেন্সি এর ব্যতিক্রম নয়। এটা জনগণ কর্তৃক চালিত আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আমাদের মেয়াদের সমাপ্তি নাগাদ ১২৫টি দেশের প্রায় এক লাখ ডেলিগেট নিয়ে আমাদের দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমজুড়ে ৬০টি শহরে ২০০টিরও বেশি সভা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। কোনো প্রেসিডেন্সি কখনই এত বিশাল ও বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক বিস্তৃতি প্রদর্শন করেনি।

ভারতের জনতত্ত্ব, গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের কথা অন্য কারো কাছ থেকে শোনা আর প্রত্যক্ষভাবে সেগুলোর বাস্তব অভিজ্ঞতালাভ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। আমি নিশ্চিত যে আমাদের জি২০ ডেলিগেটরা এর প্রতি সমর্থন জানাবেন।

আমাদের জি২০ প্রেসিডেন্সি বিভাজনগুলো কাটিয়ে ওঠার, প্রতিবন্ধকতাগুলো ভেঙে ফেলার এবং সহযোগিতার বীজ বপনের চেষ্টা করে যা এমন একটি বিশ্বকে পুষ্ট করে। যেখানে অনৈক্যের ওপর ঐক্য প্রাধান্য পায়, যেখানে যৌথ ভবিষ্যৎ গ্রাস করে বিচ্ছিন্নতাকে। জি২০-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম প্রত্যেকটি কণ্ঠস্বর শ্রবণের এবং প্রতিটি দেশের অবদান রাখাটা নিশ্চিতের মাধ্যমে বৈশ্বিক টেবিলকে আরো বৃহৎ করে তোলার। আমি এ ব্যাপারে ইতিবাচক যে আমরা কর্মকাণ্ড ও ফলাফল দিয়ে আমাদের অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেছি।

নরেন্দ্র মোদি: ভারতের প্রধানমন্ত্রী

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন