চাঁদে সফলভাবে মহাকাশযান অবতরণ করানো দেশের তালিকায় চতুর্থ হিসাবে নাম লেখাল ভারত (আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পরেই)। এর মধ্য দিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরু আবিষ্কারের কৃতিত্বও গড়লো ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো।
চাঁদের দক্ষিণ মেরু এখনও অনাবিষ্কৃত। পৃথিবীর আর কোনও দেশ সেখানে পৌঁছতে পারেনি। সেখানেই পৌঁছে গিয়েছে ভারত। চূড়ান্ত পর্যায়ের এই অবতরণ প্রক্রিয়ায় ১৯ মিনিট সময় লেগেছে। তৈরি হয়েছে ইতিহাস।
স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের ওই অংশে নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার। রহস্যে ঘেরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মাটি স্পর্শ করল ভারতের চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার। প্রথম কোনো দেশ হিসেবে চাঁদের ওই অংশে নামে চন্দ্রযান-৩।
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো জানিয়েছে, ১৪ জুলাই ঠিক দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট। ইতিহাস গড়ার পথে প্রথম পা বাড়িয়েছিল চন্দ্রযান-৩। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে চাঁদের উদ্দেশে উড়ে গিয়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর এই মহাকাশযান। দিন রাত এক করে, খাওয়া-নাওয়া-ঘুম ত্যাগ করে একে একে ৪০ দিন কাটিয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। নজর রাখেছিলেন চন্দ্রযান-৩-এর গতিবিধির উপর। ইতিহাস তৈরির মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থাকবেন বলে। অবশেষে অবসান হল সেই অপেক্ষার। ভাসতে ভাসতে ‘চাঁদের বাড়ি’ পৌঁছল ল্যান্ডার বিক্রম। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে জানান দিল ভারতীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিশাল অস্তিত্ব।
৫ অগস্ট থেকে ১৬ অগস্ট পর্যন্ত চন্দ্রযান-৩ একটি একটি করে চাঁদের কক্ষপথ নির্বিঘ্নে পেরোতে থাকে। এর মধ্যেই ৬ অগস্ট বাইরের দিক থেকে চাঁদের দ্বিতীয় কক্ষপথে প্রবেশ করে গন্তব্যের ছবি তুলে ফেলেছিল চন্দ্রযান-৩। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা গিরিখাত-এডিংটন, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টারকাস, রমনকে। ছবিতে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা ‘ওসিয়ানাস প্রোজেলেয়ারাম’। যাকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ‘ঝড়ের সমুদ্র’ও বলে থাকেন। এই ‘সমুদ্র’ আসলে জলের সমুদ্র নয়। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা এই গিরিখাতকেই পৃথিবী থেকে ‘চাঁদের কলঙ্ক’ হিসাবে দেখি আমরা। ছবিটি তুলেছিল চন্দ্রযান-৩-এ থাকা ল্যান্ডার হরাইজেন্টাল ভেলোসিটি ক্যামেরা (এলএইচভিসি)।
১৭ অগস্ট আরও গন্তব্য চাঁদের দিকে আরও এক ধাপ এগোয় চন্দ্রযান-৩। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় ১৭ অগস্টেই। রোভার প্রজ্ঞানকে পেটে নিয়ে ধীরে ধীরে চাঁদের দিকে নামতে শুরু করে ল্যান্ডারটি। প্রাথমিকভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার উপরের কক্ষপথে অবস্থান করছিল বিক্রম। এর পর চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দুর্গম খানাখন্দে ভরা মাটিতে অপেক্ষাকৃত মসৃণ জমি খোঁজার কাজ শুরু করে বিক্রম। সেই জমি খুঁজে পেতেই পেরিয়ে যায় কয়েকটি দিন। এর মাঝে চন্দ্রপৃষ্ঠের একের পর এক ছবি তুলে ইসরোতে পাঠাতে থাকে চন্দ্রযান-৩।
ভাসতে ভাসতেই অবতরণের উপযুক্ত জমি খুঁজে পেয়েছিল ল্যান্ডার বিক্রম। ২৩ অগস্ট রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে সেখানেই ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (সফট ল্যান্ডিং) শুরু করে সেটি। চার বছর আগে ঠিক যে পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরোর ‘চন্দ্রযান-২’। কিন্তু চন্দ্রযান-৩ বিফলে গেল না। ইসরোর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিট নাগাদ চাঁদের মাটিতে নেমে ইতিহাস তৈরি করল ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। দেশ জুড়ে হইহই, আনন্দ, বাজি পোড়নো। সমাজমাধ্যমে হাজারো পোস্টের বন্যা। আবার কান্নায় ভাসলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। অনেক দিনের দলা পাকানো কান্না। তবে এই কান্না আনন্দের, তৃপ্তির, আত্মবিশ্বাসের।
সম্প্রতি চন্দ্রাভিযানে গিয়ে রাশিয়ার লুনা-২৫ ভেঙে পড়েছে।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ