চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ইমরান খানের জেল : পাক রাজনীতিতে তার ক্যারিয়ার কি তবে সমাপ্তির পথে ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

৭ আগস্ট, ২০২৩ | ২:৪৮ অপরাহ্ণ

আদালত পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতির অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। রায় ঘোষণার খুব কাছাকাছি সময়েই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাজার প্রথম রাতটি তার কেটেছে একটি উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগারে।

 

দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ফলে খানকে পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হতে পারে, যেটা তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ওই রায়ে ৭০ বছর বয়সী ক্রিকেটার-রাজনীতিবিদকে ১৪০ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপিতে (৪৯৭,৫০০ ইউএস ডলার) বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

 

ইমরান অন্যায়ের কথা অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি তোশাখানা থেকে বৈধভাবেই সেই উপহার কিনেছিলেন। তার আইনজীবীরা বলছেন, ইমরানের বিচার সুষ্ঠু হয়নি এবং মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

 

তারা আল জাজিরাকে বলেন, জনপ্রিয় এই বিরোধী নেতাকে গত মে-তে গ্রেপ্তারের পর যে মারাত্মক বিক্ষোভের জন্ম নিয়েছিল, তাই দেখে ভীত সরকার। দেশের সবচেয়ে বড় দলটিতে (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ, পিটিআই) নির্বাচনের আগে ভাঙন ধরানোর সব চেষ্টা করছে।

 

গত শনিবার গ্রেপ্তারের ঠিক আগে আগে আল জাজিরাকে একটি সাক্ষাৎকারে ইমরানও এমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি সময়োপযোগী একটি ‘ধারণা’কে কিছুতেই আটকে রাখতে পারবেন না। আপনি যদি ভোটের সমীক্ষাগুলি দেখেন, পিটিআইয়ের অনুমোদন রেটিং ৭০ শতাংশ। কোন দলেরই এত জনপ্রিয়তা নেই। সুতরাং এতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা হবে পাগলামি।

 

এবারে একটু ‘আসছে’ দিনগুলোর দিকে চোখ দেয়া যাক।

 

ইমরান খান কি আপিল করতে পারবেন?

পিটিআই জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ইতোমধ্যে আপিল করা হয়েছে। পিটিআইয়ের সদস্য এবং ইমরানের আইনি দলের অংশ বাবর আওয়ান বলেছেন, এই রায় একটি প্রতারণামূলক আদালতের হাস্যকর রায়। কেননা এতে ইমরান খানকে ন্যায্য বিচার পেতে দেওয়া হয়নি, যা দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। ইমরান শুনানির জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। পাকিস্তানের আইন অনুপস্থিতিতে বিচারের সুযোগ দেয় না, যার অধীনে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাই উচ্চ আদালতে তাদের আপিলের পরে রায় স্থগিত করা এবং ইমরান খানের তাড়াতাড়ি মুক্তির সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে।

 

ইমরান কি এখনও রাজনীতিতে জড়াতে পারবেন?

এই গ্রেপ্তারের ফলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার যেকোন আশার অবসান ঘটেছে। কেননা ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত যে কেউ পাকিস্তানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। তাছাড়া পার্লামেন্টও মেয়াদপূর্তির আগে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ভেঙে দেওয়া হতে পারে এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

 

তবে আসছে শনিবার দেশটির সর্বশেষ আদমশুমারির ফলাফলের প্রকাশের পরে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে জল্পনা রয়েছে। পাকিস্তানের আইনের অধীনে নির্বাচনী এলাকাগুলোর পুনর্নির্ধারণের জন্য ওই সময়ের প্রয়োজন হবে।

 

যদি তার আপিল ব্যর্থ হয়, তাহলে এই রায় শুধুমাত্র পাঁচ বছর পর সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে রাজনীতিতে ফিরে আসতে দেবে বটে; তবে তার মামলার সংখ্যাও এক্ষেত্রে একটা ফ্যাক্টর। প্রায় ১৫০ টির মতো মামলার খাঁড়া ঝুলছে ইমরানের মাথার ওপর, যার মধ্যে দুর্নীতি এবং হত্যাচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। ইমরান অবশ্য অভিযোগ করেছেন যে, তার বিরুদ্ধে মামলাগুলি তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়ার জন্যই করা।

 

ইমরান খান কেন এত জনপ্রিয়?

ইমরান খানকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে নেহাতই ‘একটি নতুন মুখ’ হিসাবেই দেখা হয়েছিল। তবে দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির প্রতিশ্রুতিসহ তরুণ ভোটারদের তিনি যেভাবে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, তা পুরানো রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মোহ অনেকটাই ভঙ্গ করতে পেরেছিল।

 

২০১৮ সালে জনসমর্থনের ঢেউ, দুর্নীতি বিরোধী ঘোষণাপত্র এবং ‘কথিত’ শক্তিশালী সামরিক-সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান।

 

একই সময়ে, তার রক্ষণশীল ইসলাম এবং পশ্চিমা বিরোধী বক্তব্য (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে) প্রভাবশালী ধর্মীয় রক্ষণশীলদের সাথে তাকে একাত্ম হতে সাহায্য করে। তাছাড়া পরোপকারিতাও তাকে প্রচুর প্রশংসা এনে দিয়েছিল। লাহোর এবং পেশোয়ারে তার প্রতিষ্ঠিত শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল এবং গবেষণা কেন্দ্রে বেশিরভাগ রোগীর বিনামূল্যে ক্যান্সারের সেবা প্রদান তাকে অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে তুলেছিল।

 

তার শাসনামলে, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম কোভিড-১৯ আক্রান্তের রেকর্ড করেছে এবং একটি দারিদ্র্য-বিমোচন কর্মসূচি মহামারী-সৃষ্ট অর্থনৈতিক অসুবিধাগুলি দূর করতে সাহায্য করেছে।

 

গত এপ্রিলে একটি অনাস্থা প্রস্তাবে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন। একই সাথে তার মিত্ররা এবং পিটিআইয়ের কিছু এমপি তাকে ত্যাগ করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলে আসছিলেন, তার সরকারকে মার্কিন যোগসাজশে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর দ্বারা ফেলে দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যাহোক, তারপর থেকে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তার ডাকে হাজার হাজার সমর্থক বিনাদ্বিধায় রাস্তায় নেমে এসেছিল।

 

২০২২ সালের নভেম্বরে একটি সমাবেশে পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তার সমর্থন আরও জোরদার হয়। খান পরে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পিছনেও সামরিক প্রধানকে অভিযুক্ত করেন। অবশ্য তিনি তার অভিযোগের কোন প্রমাণ দেননি।

 

যখন রাজনীতিতে আসেন ইমরান

ইমরান ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, পিটিআই প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার প্লেবয় ইমেজ এড়িয়ে যান। তিনি একজন ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন যিনি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী দুটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক রাজবংশের পতন ঘটাতে সক্ষম হন। খান নিজেকে এমন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন যিনি দেশে ‘দীর্ঘদিনের দুর্নীতি মোকাবেলা করতে পারেন’ এবং ‘আইনের শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা’ নিতে পারেন।

 

রাজনীতির আগে, ইমরান একটি অত্যন্ত সফল ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন যেখানে তিনি ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে জয়ের মুকুট পাইয়ে দিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

 

সূত্র : আল জাজিরা এবং নিউজ এজেন্সি

 

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন