চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোর উত্থান, ডলার কতদিন বৈশ্বিক রিজার্ভ স্ট্যাটাস ধরে রাখতে পারবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৮ জুন, ২০২৩ | ১২:২১ অপরাহ্ণ

আসছে আগস্টে দ. আফ্রিকায় বসতে চলেছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকার জোট ‘ব্রিক্স’র বৈঠক। আর এ বৈঠকের মূল এজেন্ডাই হলো- একটা ‘যৌথ মুদ্রা’ চালু।

 

ডলারের একাধিপত্য প্রশমনে পৃথিবীর আরো কিছু দেশ দ্বিতীয় মুদ্রায় অভিন্ন বিনিময় সাপেক্ষে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার ব্যাপারে এগিয়ে আসছে। ২০১৪ সাল থেকে সদস্য দেশগুলোর ভারী অবকাঠামো নির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়নে অভিন্ন কৌশল নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিকসের ‘এনডিবি’ ব্যাংক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন ডলার ও ইউরোপের ইউরোর ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে একটি বহুজাতিক মুদ্রাব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে চীনের মুদ্রা আরএনবি (ইউয়ান)। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর হিস্যা ৪০ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট জিডিপির ৩১ শতাংশ।

 

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই নতুন ব্যাংকের সাথে যুক্ত হয়েছে। আরো যুক্ত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, বাহরাইন, আর্জেন্টিনা, বেলারুশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, নিকারাগুয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান, সুদান, সিরিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই পঞ্চপক্ষের সদস্য দেশগুলোর ১৬টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে এই ব্যাংক।

 

এনডিবি বলছে, মার্কিন ডলারের বিপক্ষে নতুন একটি অর্থনৈতিক ও মুদ্রাগত স্থাপত্য নির্মাণ এই নতুন ব্যাংকের অভীষ্ট লক্ষ্য। এই লক্ষ্য সামনে রেখে ডলারবিহীন লেনদেন চালু করছে নতুন এই ‘মিনি বিশ্বব্যাংক’। ২০২৬ সাল নাগাদ ঋণ কার্যক্রম প্রবর্তনকারী তালিকাভুক্ত সদস্য দেশগুলো তাদের নিজ মুদ্রার মাধ্যমে লেনদেন ও ঋণপত্র খুলতে পারবে। এই দেশগুলো যদি মার্কিন ডলার না কেনে এবং অন্য একটি অভিন্ন মুদ্রা দিয়ে লেনদেন শুরু করে তাহলে চলতি বছর শেষ হতে না হতেই ডলারের একাধিপত্য তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। একটি দুর্বল মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের আস্থার যে জায়গাটা ধসে যেতে পারে, তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার ধারণাও গবেষকদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে।

 

গত বছরের জুনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মার্কিন ডলারের আধিপত্য হ্রাসের জন্য যে বিশ্বমোর্চা গড়ার ডাক দেন, ডলারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমর্থন তা থেকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়। এরই সাংগঠনিক পরিণতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের তারল্য মজুত নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই ব্যাংক (নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এনডিবি)। ডলার কিংবা ইউরোর বিপক্ষে তৃতীয় একটি বৈশিক মুদ্রাব্যবস্থার গোড়াপত্তন ইতোমধ্যেই কাঁপিয়ে দিয়েছে ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ ভিতকে। ব্রিকসের ব্যাংকের সহযাত্রী হিসেবেই প্রবর্তন ঘটেছে ব্রিকস ক্যাপিটাল শেয়ার মার্কেট, যা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক স্টক এক্সচেঞ্জের মতো বড় বড় শেয়ার দুর্গে অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে।

 

ইতিহাসে এটি অবশ্যই লেখা থাকবে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন ডলারে লেনদেন কোনো সার্বভৌম দেশ প্রথম প্রত্যাখ্যান করেনি, করেছে একটি রুশ কোম্পানি-রুশ রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপপ্রম। শেভরন তেল কোম্পানি সারা দুনিয়ায় ব্যবসায় করে, এমনকি তারা তাদের দু’টি সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে খোদ রাশিয়ায়ও ব্যবসায় করে মুনাফা হাতাচ্ছে। তারা যদি মার্কিনিদের অন্য দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করার সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে টুঁ শব্দটি না করে তাহলে রাশিয়া বা চীনের বা অন্য কোনো দেশের বড় কোনো কোম্পানি ডলারে লেনদেন না করার বীরত্ব দেখাতেই পারে।

 

ডলারকে ধরাশায়ী করতে ২০০৮ সাল থেকে অর্থাৎ অর্থব্যবস্থায় নতুন আঘাত আসার পর থেকে একের পর এক প্রয়াস চলেই আসছে। এতগুলো চলমান উদ্যোগের পরিণতি কি নিষ্ফল হতে পারে? বিশেষ করে যার পেছনে আছে রাশিয়া ও চীন, ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রপুঞ্জ? জাতিসঙ্ঘ গঠনে যে অপূর্ণতা ছিল, নিরাপত্তা পরিষদ কাঠামোর যে সীমাবদ্ধতা ছিল, এতদিনে মীমাংসার পথে এলো এ পৃথিবী। এখনো বাকি থেকে গেল ডলার তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের দিবাবসান।

 

দু’ দু’টি মহাযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একদিন আমেরিকা প্রায় গোটা পৃথিবীর স্বর্ণ ধাতব লুট করে বিশেষ করে ইউরোপের মেধা হাতিয়ে নিয়ে ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ সৌধ তৈরি করে। একচ্ছত্র শক্তিতেই তারা সবাইকে ‘ব্রেটন উড’ চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করে। সেই ব্রেটন উড চুক্তিরই ফসল বিশ্বব্যাংক (যা এখন ‘বিশ্বব্যাংক গ্রুপ’ নামে বিস্তৃত এবং সংগঠিত) তৈরি করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। এই প্রতিষ্ঠান দু’টি জগতের যা উপকার করেছে, অনিষ্ট করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

 

ইউরোপীয় জাতিগুচ্ছ ইউরো মুদ্রাকে আরো খানিকটা শক্তিশালী করতে পারত, যদি স্বার্থপর ও বিশ্বাসঘাতক যুক্তরাজ্য আমেরিকার পরম বন্ধুত্ব (প্রকারান্তরে স্বেচ্ছাদাসত্ব) শুরু না করত ( ব্রেক্সিট)।

 

সে যাক, মানতেই হবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাণিজ্যে ডি-ডিলারাইজেশন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। অনেক দেশই এখন মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় নিয়ে বিচার–বিবেচনার অবকাশ আছে। বিষয় দুটি হলো প্রথমত, ব্রিকস জোটের দেশগুলোর সবার স্বার্থ এক নয়; দ্বিতীয়ত, নতুন মুদ্রার সম্ভাবনা ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা। তবে অভিন্ন মুদ্রা থাকলে ব্রিকস জোটের সদস্য দেশগুলোয় নিজেদের মধ্যেকার বাণিজ্যই কেবল বাড়বে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের মুদ্রা ডলারে রূপান্তরের যে উচ্চ ব্যয়, তা থেকেও রেহাই পাবে।

 

এক্ষেত্রে ব্রিকসের শক্তি হলো- বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩২ শতাংশ এখন ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর। ফলে ব্রিকস দেশগুলো বাণিজ্যের জন্য শুধু ব্রিকস মুদ্রাই ব্যবহার করবে, এমন চিন্তাকে বাস্তবসম্মত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।

 

তবে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যবধান অনেক। অর্থাৎ মুদ্রা ইউনিয়ন গঠনের আগে দেশগুলোকে মুদ্রার অবনমনের বিষয়ে অবশ্যি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। আর আসন্ন বৈঠকে দেশগুলো এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে বলেই মনে হয়।

[তথ্যসূত্র: ফরচুন)

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট