প্রফেসর ইয়ান লেকুন, জিওফ্রে হিন্টন এবং ইয়োশুয়া বেঙ্গিওর- এ তিনজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী একনামে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা এআই-এর গডফাদার’ হিসাবে পরিচিত। ২০১৮ সালে এ তিন বিজ্ঞানী এআই- তে তাদের সাফল্যের জন্য টুরিং অ্যাওয়ার্ড (টুরিং পুরস্কার কম্পিউটার বিজ্ঞানে অবদানের জন্য প্রদান করা একটি সম্মাননা। অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি বা এসিএম প্রতি বছর এই পুরস্কারটি প্রদান করে থাকে। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত এবং এটিকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বলা হয়ে থাকে) জিতেছিলেন। এই তিন গডফাদারের অন্যতম প্রফেসর ইয়ান লেকুন বলেছেন, ‘এটি বিশ্ব দখল করবে না বা কোনোও চাকরিও স্থায়ীভাবে ধ্বংস করবে না। তিনি এমনকি কিছু বিশেষজ্ঞের ‘এআই মানবতার জন্য হুমকি’- এমন আশঙ্কাকে ‘অযৌক্তিকভাবে হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার কথায়, ‘কম্পিউটার মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে- এমন আশংকা যদি সত্যিও হয়ে থাকে, তবে তা এখনও অনেক দূরের কথা। তাছাড়া যদি আপনি বুঝতে পারেন এটি নিরাপদ নয় তবে আপনি এটি তৈরি না করলেই হলো!’ যুক্তরাজ্য সরকারের একজন উপদেষ্টা সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন যে, কিছু শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে।
যাহোক, প্রফেসর লেকুন এখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপের মূল কোম্পানি মেটাতে প্রধান এআই বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি তার সহকর্মী ‘গডফাদার’দের সাথে একমত নন যে, ‘এআই মানব জাতির জন্য একটি ঝুঁকি।’ তার কথায়, এআই মোটেই বিশ্ব দখল করতে যাচ্ছে না, এটি মেশিনে মানব প্রকৃতির একটি অভিক্ষেপ মাত্র। নানা ছুতো তুলে এআই গবেষণাকে ‘তালা এবং চাবির অধীনে রাখা’ একটি বিশাল ভুল হবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, লোকেরা উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, এআই মানুষের জন্য ঝুঁকি হতে পারে কারণ তারা এটিকে (এআই) কীভাবে নিরাপদ করা যায় তা ভেবে উঠতে পারেনি। তার কথায়, এটা অনেকটা এমন যে, যদি আপনি ১৯৩০ সালে কাউকে জিজ্ঞাসা করতেন- “আপনি কীভাবে একটি টার্বো-জেটকে নিরাপদ করতে যাচ্ছেন?” অথচ ১৯৩০ সালে টার্বো-জেট তখনও আবিষ্কৃতও হয়নি- ঠিক তেমনই মানব স্তরের এআই এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। আশার কথা, টার্বো জেটগুলি শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছিল। আর তার ভাষায়, এআই-এর ক্ষেত্রেও এটি ঘটবে বলে তিনি বিশ^াস করেন। মেটার একটি বড় এআই গবেষণা প্রোগ্রাম রয়েছে এবং মানুষের মতো সক্ষম বুদ্ধিমান সিস্টেম তৈরি করা এর অন্যতম লক্ষ্য। গবেষণার পাশাপাশি, কোম্পানি ক্ষতিকারক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট শনাক্ত করতে এআই ব্যবহার করে।
অধ্যাপক লেকুন আমন্ত্রিত প্রেসের সামনে রাখা বক্তব্যে বলেন, তথাকথিত অবজেক্টিভ ড্রাইভেন এআই-তে তার নিজের কাজের লক্ষ্যটি হল- এমন নিরাপদ সিস্টেম তৈরি করা যা মনে রাখতে পারে, যুক্তি দিতে পারে, পরিকল্পনা করতে পারে এবং যার সাধারণ জ্ঞান থাকতে পারে। চ্যাট জিপিটি- এর মতো জনপ্রিয় চ্যাটবটগুলিতে এসবের অভাব রয়েছে।
তিনি বলছিলেন, এআই একদিন হয়তো মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে গবেষকরা এখনও সেই স্তরে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় ধারণা দিতে পারছেন না। ওই স্তরে পৌঁছাতে কয়েক দশক না হলেও কয়েক বছর তো অবশ্যি লাগবে।
যখন লোকেরা ভবিষ্যতে মানব-স্তরের বা তার উপরের স্তরের বুদ্ধিসম্পন্ন মেশিনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন তারা আসলে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই বা আর্টিফিসিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স)-এর কথা উল্লেখ করে। এগুলি এমন সিস্টেম, যা মানুষের মতো, বিস্তৃত সমস্যার সমাধান করতে পারে। একটি ভয় ছিল যে, এজিআই ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এমন ‘সুপার-বুদ্ধিমান সিস্টেম’ চালু করতে পারেন যা কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশ্বকে দখল করতে পারে। এমন ধারণাকে অধ্যাপক লেকুন রীতিমতো ‘হাস্যকর’ কলেই মন্তব্য করেছেন।
চাকরিতে প্রভাব
কিছুদিন ধরেই বেশ বলাবলি হচ্ছে এআই-এর অনেক মানুষের চাকরি প্রতিস্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং কিছু কোম্পানি তাদের অনেক নতুন ‘নিয়োগ’ থামিয়ে দিয়েছে। অধ্যাপক লেকুন বলেছেন : এটি অনেক লোককে স্থায়ীভাবে কাজ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না। তবে এটা ঠিক সামনে কাজের ধরনের পরিবর্তন হবে কারণ আমাদের ‘কোনোও ধারণা নেই’ এখন থেকে ২০ বছর পর সবচেয়ে ‘স্পেশাল’ চাকরিগুলি কী হবে। তবে বুদ্ধিমান কম্পিউটার ‘মানবতার জন্য একটি নবজাগরণ’ তৈরি করবে, যেভাবে ইন্টারনেট বা প্রিন্টিং প্রেস একসময় করেছে।
প্রফেসর লেকুন গত মঙ্গলবার ইউরোপের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে তার মতামত দিতে এসে বলেছেন, প্রবিধান অবশ্যি থাকা উচিত, তবে সেটা যেন এআই- অ্যাপ্লিকেশন নির্ভর হয়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, গাড়িতে ব্যবহৃত এআই সিস্টেম আর মেডিকেল ইমেজ স্ক্যানিংয়ে ব্যবহৃত এআই সিস্টেম’র জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রবিধান থাকা প্রয়োজন।
[সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে]
পূর্বকোণ/এসি