
থ্রম্বোসিস হলো রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার অবস্থা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে রক্তের স্বাভাবিক জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ক্লটিং বলা হয়। জমাট বাঁধা রক্তকে ক্লট বা থ্রাম্বোস বলা হয়। রক্তক্ষরণ ব্যতীত অকারণে যদি রক্ত জমাট বাঁধে কিংবা এর স্বাভাবিক অপসারণ প্রক্রিয়া ব্যহত হয় তখন সেটি থ্রম্বোিসস নামে পরিচিত। রক্তের উপাদানের তিনটি রক্তকোষের একটি অনুচক্রিকা এবং রক্তরসে থাকা ১৩টি ক্লটিং ফ্যাক্টর একে একে ক্ষুদ্র রক্তনালীর ক্ষত বন্ধ করতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্লট তৈরি করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া অকারণে হলে বা রক্ত জমাটের স্বাভাবিক অপসারণ বিলম্বিত হলে থ্রম্বোসিস এবং প্রকারান্তরে এম্বোলিজম ঝুঁকির সৃষ্টি হয়।
থ্রম্বোসিস যে কোনো শিরা বা ধমনীতে হতে পারে- যেমন, শিরার মধ্যে পায়ের গভীর শিরার থ্রম্বোসিস (ডিভিটি), পালমোনারি এম্বোলিজম (পিই) এবং হৃদপিণ্ডের করোনারি আর্টারি বা ধমনীর থ্রম্বোসিস। রক্ত জমাট বাঁধার পর এটি রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহের গতিকে ধীর বা বন্ধ করতে পারে। কখনও কখনও এটি উৎপত্তিস্থল থেকে ছুটে গিয়ে ফুসফুস, মস্তিষ্ক বা হৃদপিণ্ডে পৌঁছে বিপদজনক এম্বোলিজম সৃষ্টি করতে পারে যা প্রাণঘাতী।
স্থান, কাল, লিঙ্গ নির্বিশেষে, মানুষের মৃত্যুর প্রধান প্রতিরোধযোগ্য কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, থ্রম্বোএম্বোলিক স্ট্রোক (ব্রেইন স্ট্রোক) এবং শিরার থ্রম্বোএম্বোলিজম (ভিটিই) ডিভিটি ও পালমোনারি এম্বোলিজম। তাই থ্রম্বোসিস সচেতনতা এবং প্রতিরোধ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর, আন্তর্জাতিক থ্রম্বোসিস এন্ড হিমোস্ট্যাসিস সংস্থা ১৩ অক্টোবর রুডলফ ভার্সোর জন্মদিনকে ‘ওয়ার্ল্ড থ্রম্বোসিস’ ডে সচেতনতা দিবস হিসাবে পালন করে। এর মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং করণীয় সম্পর্কে শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে সীমিত সম্পদের দেশগুলোর জন্য এটিই সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য: ‘থ্রম্বোসিস প্রতিরোধ করুন, আপনার স্বাস্থ্য রক্ষায় আপাদমস্তক নিয়ন্ত্রণে নিন’।
কেন সচেতনতা ও প্রতিরোধ জরুরি : বিপদজনক কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য এই থ্রম্বোসিসের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। এর জন্য চাই উন্নত প্রযুক্তি ও সুদক্ষ বিশেষজ্ঞ জনবল। আমাদের দেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এটি আরও চ্যালেঞ্জিং।
প্রতিরোধের উপায়:
১. সঠিক ওজন ও বিএমআই নিয়ন্ত্রণ- নিয়ন্ত্রিত শর্করা গ্রহণ, আঁশযুক্ত শাকসবজি এবং পরিমিত পানিসহ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ। একাধারে ২ দিনের বেশি বিরতি না দিয়ে মিনিটে ১১০-১২০ কদম করে প্রতিদিন ৩৫-৪০ মিনিট হাঁটা সপ্তাহে ৫ দিন।
২. ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস এড়ানো বা নিয়ন্ত্রণ- ধূমপান, মদ্যপান ও কোমল পানীয় বর্জন, লাল মাংস পরিহার, নিয়মিত চিকিৎসা ও ফলোআপে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শরীরের লিপিড বা চর্বি নিয়ন্ত্রণ।
৩. নারীদের জন্য সতর্কতা- প্রসব পরবর্তী এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ব্যবহারে চিকিৎসকের পরামর্শ।
৪. হাসপাতাল বা বড় সার্জারির পরে সতর্কতা- বড় সার্জারি, দীর্ঘমেয়াদে হাসপাতালে ভর্তিকৃত এবং বয়োবৃদ্ধ রোগীদের থ্রম্বোসিস ঝুঁকির প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. ক্যান্সার রোগীদের জন্য সতর্কতা- থ্রম্বোসিস ঝুঁকিপূর্ণ ক্যান্সারের চিকিৎসাকালীন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ ঔষধ গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন।
৬. বংশগত ঝুঁকি যাচাই- হৃদরোগ বা স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে বংশগত থ্রম্বোফিলিয়া স্ক্রিনিং (প্রোটিন সি, প্রোটিন এস, এন্টি থ্রম্বিন ইত্যাদি)
চিকিৎসা: রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ও দীর্ঘসূত্রিতায় মৃত্যু অনিবার্য। তাই আমাদের দেশে প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর উপায়।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
পূর্বকোণ/ইবনুর