চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা তৈরি হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব

পর্ব-১

১৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ১২:৩২ অপরাহ্ণ

ভালো স্বাস্থ্য সুস্থ জীবনের প্রতীক। ডায়াবেটিস রোগের বিষয়ে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নাগরিকের সুস্বাস্থ্যের অভাবে দেশের উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং এটি উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারলে ডায়াবেটিসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

পরিসংখ্যান

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৪০ কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি, বছরে বাড়ছে আরও ১ লাখ রোগী। ৬১.৫% টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী ভাবেন তার ডায়াবেটিস নেই।

 

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের মতে, প্রতি দু’জন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে একজন জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর আশঙ্কা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী ৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হবে ডায়াবেটিস। আর তখন মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

 

রক্তের গ্লুকোজ কত হলে ডায়াবেটিস

 

আমাদের শরীরে সাধারণত গ্লুকোজের পরিমাণ ৩.৩ থেকে ৬.৯ মিলি মোল/লি থাকে। খালি পেটে যদি ৭ মিলি মোল/লি এবং খাবার গ্রহণের পর ১১ এর বেশি থাকে তবে ডায়াবেটিস রোগ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

 

কত ধরনের ডায়াবেটিস আছে

 

ডায়াবেটিসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটির ক্ষেত্রে এই ধরনের রোগীর দেহে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সে এটি হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যেতে পারে এবং ইনসুলিন নিতেই হয়।

 

দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ৩০ বছরের বেশি বয়সে এ রোগ হতে পারে। এ রোগীর ক্ষেত্রে দেহে ইনসুলিন তৈরি হলেও অপর্যাপ্ত, তবে এ ধরনের রোগীর সবসময়ই ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ব্যায়াম, উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মমাফিক প্রাত্যহিক জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্ভব। এ ধরনের রোগীরা স্থূলকায় হয়ে পড়ে।

 

এছাড়াও জেনেটিক কারণে, অগ্নাশয়ের বিভিন্ন রোগের কারণে এ রোগ হতে পারে। এসব কারণে ডায়াবেটিস যাদের থাকে তারা অপুষ্টিতে ভোগে এবং ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। আরেক ধরনের ডায়াবেটিস হয় গর্ভকালীন সময়ে প্রসূতিদের ক্ষেত্রে। বেশিরভাগ সময়ে এ ডায়াবেটিস প্রসবের পর থাকে না। তবে এক্ষেত্রে ভ্রূণের সদ্য প্রসূত সন্তানের ক্ষতি হতে পারে।

 

ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ

 

ডায়াবেটিস রোগটি যেকোন বয়সের মানুষের হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান থাকে; যেমন- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ক্ষুধা লাগা, ওজন কমে যাওয়া, কিডনি, চোখসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর শারীরিক জটিলতা অনেক, তবে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচরণে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্মমুখর জীবনযাপন সম্ভব। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

 

কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন ডায়াবেটিস 

 

অনিরাময়যোগ্য হলেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। এ রোগে একবার আক্রান্ত হলে তা আর ভালো হয় না। কিন্তু নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, সঠিক চিকিৎসা, পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে রাখতে পারে সুস্থ এবং করতে পারে দীর্ঘায়িত।

 

ডায়াবেটিসের সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, কম শারীরিক পরিশ্রম, বড় ধরনের আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অবেসিটি বা স্থূলতা এবং বংশগত কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার এ রোগের কারণ নয়।

 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথম খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। সাথে সাথে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এজন্য প্রথমেই দরকার কার্বোহাইড্রেট/শর্করা জাতীয় খাবার যেমন- মিষ্টি জাতীয় খাবার, ভাত, আলু, সুজি, ত্রুটি ইত্যাদি খাবার পরিমাণমতো খেতে হবে।

 

মিষ্টি জাতীয় খাবার একেবারেই পরিহার করা উচিত। পক্ষান্তরে বেশি করে শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। আঁশ জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার এবং ফাস্ট ফুড ও কোল্ড ড্রিংকস পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন এ রোগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম।

 

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর দিক

 

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে মানুষ পক্ষাঘাত, হৃদরোগ, চক্ষুরোগ, পচনশীল ক্ষত, মাড়ির প্রদাহ, একজিমা, মূত্রাশয়ের রোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস নিঃসন্দেহে মারাত্মক, তবে ছোঁয়াচে নয়। আগে একসময় ঘন ঘন প্রস্রাব হলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো। গবেষণায় এটি ভুল প্রমাণিত। কেবল রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করেই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।

 

ডায়াবেটিস রোগীর দেহে যেকোন ক্ষত শুকাতে সময় লাগে। সবচেয়ে বেশি ক্ষত হয় পায়ে। ডায়াবেটিস রোগীর ব্রেইন স্ট্রোক হয়, কিডনি, চোখ ইত্যাদি অঙ্গের ক্ষতি হয়; তবে পায়ের যত্ন করতে হয় বেশি। কারণ পচন শুকাতে দেরি হয় বলে সাধারণ মানুষের তুলনায় পা কেটে ফেলার প্রবণতা থাকে বেশি।

 

রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণের তারতম্যে ডায়াবেটিস কমবেশি হয়। খুব বাড়লে হাইপার এবং কমে গেলে হাইপো বলা হয়। দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি। ইনসুলিন যারা নিয়ে থাকেন তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে ডোজ নির্ধারণ করে নিতে হবে।

 

লেখক: ডা. এ এস এম তাওহীদুল আলম

এমবিবিএস, এমসিপিএস, এমডি, এমআরসিপি, পিএইচডি মেডিসিন, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ; এপিক হেলথ কেয়ার লি.

 

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট