মেয়েদের জীবনে মেনোপজ বা মাসিক উঠে যাওয়া হল তার জীবনের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। নারীর শরীরের ডিম্বাশয় থেকে যখন হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয় তখন হরমোনের অভাবের কারনে তার মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এটাই মেনোপজ। শুধু মেয়েদের মেনোপজ হয় তা নয়। ছেলেদেরও হয়। তবে মেয়েদেরটা স্পষ্ট বুঝা যায় এবং তার শরীর ও নানাভাবে তাকে জানান দেয় -যে মেনোপজ হয়েছে।
কখন মেনোপজ?
-সাধারণত মধ্যবয়সী নারীর কারো মাসিক টানা ১২ মাস না হলে মেনোপজ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
-সাধারণত ৫১ বছর বয়সের দিকে মেনোপজ হয়। কিন্তু এটা ৪৫–৫৫ বছর বয়সের মধ্যে হতেও পারে।
-এছাড়া যদি কোন কারনে জরায়ু অপারেশনের সময় বা অন্য কোন কারণে দুটো ডিম্বাশয় ফেলে দিতে হয়- সেটাও মেনোপজ।
-ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেয়ার কারনেও ডিম্বাশয় নষ্ট হয়ে যাবার কারণে মেনোপজ হয়।
-মেনোপজের পরে দীর্ঘ একটা সময় মেয়েদের জীবনে পার করতে হয়- একে বলে পোস্ট-মেনোপজ।
মেনোপজের উপসর্গ:
মাসিক উঠে যাবার আগে হরমোন কমে যাওয়ার কারণে মেয়েদের নানা রকম উপসর্গ হয়। তবে সবাই যে একই রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যায় তা নয়। মেনোপজের কাছাকাছি সময়ের সমস্যাগুলো হলো….
১.অনিয়মিত মাসিক
২. হট ফ্লাশ- অতিরিক্ত গরম অনুভব
৩. ঘুমে সমস্যা
৪. কিছু মনে রাখতে অসুবিধা
৫. মাথা ব্যথা
৫. মেজাজ পরিবর্তন
৬. মাসিকের রাস্তা শুকনো হয়ে যাওয়া
৭. ওজন বৃদ্ধি
৮. চামড়া কুঁচকে যাওয়া
#কি সমস্যা – কি সমাধান:
#হট ফ্লাশ-
খুব কমন প্রবলেম। যদিও কি কারণে হয় তার সঠিক কারণ পাওয়া যায়নি । তবে ধারনা করা হয়- ব্রেইন এর যে অংশ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তার পরিবর্তনের জন্য এটা হয়। যার ফলে মহিলাদের গরম অনুভূতি হয়, মুখ লাল হয়ে যায়, ঘাম হয়, হার্টবিট বেড়ে যায়। সাধারণত মাসিক উঠে যাবার সময় ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত এ সমস্যা থাকতে পারে। কারো কারো দীর্ঘ ১০ বছরও থাকতে পারে। চিকিৎসা করে এই সমস্যাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে কমানো যায়। অনেক সময় হরমোন চিকিৎসাও লাগতে পারে। যারা হরমোন নিতে চায় না তাদের এসএসআরআই গ্রুপের ওষুধ- পেরোক্সেটিন দেয়া যায়। চিকিৎসা না করলেও সময়ের সাথে সাথে এটা বন্ধ হয়ে যায়। জীবনযাত্রার সমস্যা না করলে এর চিকিৎসার দরকার নেই।
#ঘুমের সমস্যা
ঘুমের সমস্যা হলে জীবন যাত্রার পরিবর্তন আনতে হবে।
যেমন- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া,ঘর ঠান্ডা রাখা,কফি-চা কমিয়ে দেয়া।
#স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
এ সমস্যা হবার পর বা আগে থেকেই প্রতিরোধের জন্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে- সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়া, শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম থাকা, সুষম খাবার খাওয়া, সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ,কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এবং প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ নিয়ম পালনে স্মৃতিশক্তি কমার ঝুকি কমবে ।
#মাথা ব্যথা
যাদের আগে থেকেই মাসিকের সময় মাথাব্যথা হতো তাদেরই মেনোপজ হলে একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হয়। সাধারনত মাসিক উঠে যাবার কাছাকাছি সময়ে এ সমস্যা বেশি হয়। তবে যখন মাসিক সম্পূর্ন বন্ধ হয় তখন মাথাব্যথার সমস্যা আবার কমে যায়। চিকিৎসা বলতে – সামান্য ব্যাথার ওষুধেই কাজ হয় সাধারণত ।
#মেজাজ পরিবর্তন
ডিপ্রেশন খুব কমন একটা সমস্যা এসময়।এছাড়া মন খারাপ,তিরিক্ষি মেজাজ তো আছেই। বুড়িয়ে যাওয়ার অনুভূতি সবাইকে মন খারাপ করিয়ে দেয়। সাধারণত ইসট্রোজেনের তারতম্যের কারনে এটা হয়।
-যদি ডিপ্রেশন হয় তখন মানসিক সাপোর্টের সাথে সাথে ওষুধের সাহায্যও লাগতে পারে।
-যদি সাথে হট ফ্লাশও থাকে তাহলে হরমোন থেরাপি দিলে দুই সমস্যারই সমাধান হয় ।
#মাসিকের রাস্তা শুকনো-
সাধারনত হরমোন কমে যাওয়াতে মাসিকের রাস্তার চামড়ার রস কম নিঃসৃত হবার কারনে এটি হয়। মাসিকের রাস্তা শুকনো থাকার কারনে, সহবাসে ব্যথা হয়,প্রস্রাব ঘনঘন হয়,ঘন ঘন পস্রাবের ইনফেকশন হয়। এর চিকিৎসায় – মাসিকের রাস্তা পিচ্ছিল করার জন্য লুব্রিকেন্ট, মময়েশ্চারাইজার দিলে আরাম পাওয়া যায়।
তাতেও সমস্যার সমাধান না হলে ইসট্রোজেন হরমোন ক্রিম দিলে উপকার পাওয়া যায়।অনেক সময় মেনোপজ হলে যৌন উত্তেজনা কমে যেতে পারে।এটা শুকনো হবার কারনেও হতে পারে বা মানসিক পরিবর্তনের জন্যও হতে পারে।
#চামড়া কুঁচকানো
হরমোন কমার ফলে কোলাজেন নামক পদার্থ শরীরে কমে যায়।এতে চামড়ায় বয়সের ছাপ পড়ে।এছাড়া চামড়ার ময়েশ্চার ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে যায় মেনোপজ হলে। সাথে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রতি সংবেদনশীলতার কারনেও চামড়ার পরিবর্তন হয়।যার কারনে এ থেকে রক্ষা পেতে ভালো সানস্ক্রিন দেয়া, মাথায় কাপড়/টুপি কিংবা সানগ্লাস পড়লে উপকার পাওয়া যায়।
তবে আসল সমাধান জীবনযাত্রার পরিবর্তনে।সেজন্য – সুষম খাবার,পর্যাপ্ত ঘুম, প্রচুর পানি এবং চামড়ায় ময়েশ্চারাইজার লাগানো জরুরি।
#ওজন কমাতে সমস্যা
মাসিক উঠে যাবার পর ওজন কমানো অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এটার জন্য মেনোপজ দায়ী নয়। মধ্যবয়সী টানাপোড়ন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারনে এটা হয়।তাই এসময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে ওজন না বাড়ে। ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
#আর্থ্রাইটিস/ জয়েন্ট ব্যথা-
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর্থ্রাইটিসের সমস্যা বেড়ে যায়। সাথে স্থূলতা থাকলে সমস্যার প্রকটতা আরো বেশি হয়।
-ওজন নিয়ন্ত্রন এবং ব্যায়াম করে মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি… ব্যাথা কমাতে সাহায্য করবে।
#চুল পড়া
মেনোপজে হরমোন কমে যাওয়ায় এ সমস্যা হয়। তবে কারো থাইরয়েড সমস্যা থাকলেও এটা হতে পারে। সুষম খাবারের পরিমান ঠিক রাখতে হবে। সাথে লাল মাংশ বাদ দিয়ে…জিংক-আয়রন-ভিটামিন ডি, বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার ও মাল্টিভিটামিন খেলে চুল পড়া কমবে।
#হাড় ক্ষয়
হাড় ক্ষয় মেনোপজ পরবর্তী প্রধান সমস্যা। যার ফলে হাড় ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়।যদিও মহিলাদের ৩০ এর পরই হাড় ক্ষয় শুরু হয়।কিন্তু মাসিক উঠে গেলে ক্ষয় দ্রুততর হয়। এজন্য মেনোপজ হলে ক্ষতি কতটুকু হয়েছে দেখার জন্য ৬৫ বছর বয়সের পর বিএমডি (BMD) নামক পরীক্ষা করতে হবে। যদি ক্ষয় বেশি হয় তাহলে চিকিৎসা করতে হবে।
#মেনোপজ-হরমোনবিহীন চিকিৎসা
খাবারের সাপ্লিমেন্ট, কিছু ভিটামিন জাতীয় ওষুধ একে মোকাবিলায় সাহায্য করে- তবে কিভাবে তা করতে হবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে করতে হবে।
#মেনোপজে হরমোন থেরাপি – নাকি ম্যাজিক
মাসিক উঠে গেলেই কি যৌবন ধরে রাখার জন্য হরমোন থেরাপি সবার প্রয়োজন!? এটা কি উপসর্গ থেকে মুক্তির মহৌষধ?
এই থেরাপি নেয়ার আগে যাচাই করতে হবে সব মেনোপজ হওয়া মহিলার এটা দরকার আছে কিনা।
সাধারণত হটফ্লাশ যাদের হয় বা যাদের যৌনাঙ্গের সমস্যা প্রকট হয়- ঝুঁকি বিবেচনা করে তাদের এটা দিতে বলা হয়।হরমোন নানাভাবে দেয়া যায়- যেমন- ট্যাবলেট, প্যাচ, স্প্রে, জেল হিসেবে।এতে আছে ইসট্রোজেন হরমোন।এ হরমোন দিতে গেলে জরায়ুর ক্যান্সার ঝুঁকি কমানোর জন্য সাথে প্রজেস্টোরন হরমোনও দেয়া হয়।
যাদের জরায়ু নাই তাদের শুধু ইসট্রোজেন দিলেই হয়।
এটা দীর্ঘদিন দিলে স্তনক্যান্সার ও রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেড়ে যায়, তবে সেটা টানা ৫ বছর খাবার/ব্যবহার এর পর। তাই হরমোন যারা নেয় সেই মহিলাদের প্রতি বছর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফলোআপ করতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে- সব মেনোপজ মহিলাকে হরমোন না দিয়ে যার দরকার যাচাই করে তবেই দেয়া। হরমোন ম্যাজিক হলেও এ যাদু সবার উপর না চালানোই ঠিক।
এখন ২০২০। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় মহিলাদের জীবনের বিশাল একটা সময় মেনোপজের পরে কাটাতে হয়। এবং মেনোপজ জীবনের অলঙ্ঘনীয় একটা অধ্যায়।
এ সময়ে সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে সব মহিলাকে। মেনোপজের সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কেও জানতে হবে নারীদের।এবং সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, সুষম খাবার, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিলে মেনোপজ পরবর্তী জীবন হতে পারে সুন্দর, সুস্থ ও অর্থবহ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (গাইনি), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
পূর্বকোণ/এএইচ