হিমোফিলিয়া একটি বিরল বিশেষায়িত অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণজনিত রক্ত রোগ। যেটির কারণ প্রধানত নারী। কিন্তু আক্রান্ত হয় পুরুষ। তবে ক্ষেত্র বিশেষে নারীও আক্রান্ত হতে পারে। প্রধানত রক্তের জলীয় প্লাজমা অংশে থাকা রক্ত জমাট সহায়ক প্রোটিন ফ্যাক্টর ৮ ও ৯ এর ঘাটতি (যেটি ‘ঢ’ ক্রোমজোম সংশ্লিষ্ট ) জনিত কারণে হয়ে থাকে। ফ্যাক্টর ৮ ও ৯ এর ঘাটতি জনিত হিমোফিলিয়া কে যথাক্রমে হিমোফিলিয়া ‘এ’ ও হিমোফিলিয়া ‘বি’ নামে অভিহিত করা হয়।
বিশ্বে হিমোফিলিয়া ‘এ’ প্রতি ৪০০০-৫০০০ জনে এবং ‘বি’ এর প্রকোপ প্রতি ১৫০০০-৩০০০০ জনে ১ জন। হিমোফিলিয়া ‘এ’ বা ‘বি’ ছাড়াও ফ্যাক্টর ১১ এর স্বল্পতা জনিত কারণে রক্তক্ষরণকে (যদিও এটি অতি বিরল) আমরা হিমোফিলিয়া ‘সি’ বা রোজেনথাল সিনড্রোম নামে অভিহিত করে থাকি।
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণজনিত রোগ হলেও হিমোফিলিয়ার লক্ষণসমূহ একটু ভিন্ন; সাধারণ রক্তক্ষরণের মত নয়। রক্তক্ষরণ অনেক কারণে হতে পারে।
অস্ত্রোপচার পরবর্তী রক্তক্ষরণ আপাতদৃষ্টিতে অনুচক্রিকা বা রক্তের প্লাটেলেট’র মাধ্যমে বন্ধ হলেও ডিলেইড ব্লিডিং হিমোফিলিয়ার লক্ষণ। তবে হিমোফিলিয়া রোগের রক্তক্ষরণ সাধারণত দৃশ্যমান হয় না। জয়েন্ট বা বড় বড় অস্থি সন্ধির মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়। যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের হাঁটা-চলার সময় ঘর্ষণের সৃষ্টি হওয়ার ফলে ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র রক্ত নালী ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হলে স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ না হয়ে গিরা বা অস্থিসন্ধি ফুলে উঠে।
মুসলিম সম্প্রদায় মুসলমানি পরবর্তী তাৎক্ষণিক রক্তক্ষরণ বন্ধ হলেও হিমোফিলিয়া আক্রান্ত থাকলে পরবর্তীতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। শিশু যখন হামাগুঁড়ি বা হাঁটতে শিখে বারংবার আঘাত পায় তৎপরবর্তী শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে কালচে বর্ণ (হেমাটোমা) হয়ে যায় তখনই এই রোগটি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের নজরে আসে। সর্বোপরি যেহেতু মাতৃজিন ‘ঢ’ এর জন্য দায়ী সেক্ষেত্রে মায়ের পারিবারিক ইতিহাস এটিকে শনাক্তকরণে যথেষ্ট সহায়ক। এই রোগের পরিণতি বারংবার রক্তক্ষরণ হয়ে অস্থি সন্ধি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিকলাঙ্গ বা শারীরিক প্রতিবন্ধীত্ব বরণসহ অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে অস্ত্রোপচার পরবর্তী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
রোগ নির্ণয়:
১। রক্তক্ষরণ (সাধারণত নিদির্ষ্ট প্রকৃতির- ডিলেইড, অদৃশ্যমান, শরীরের গভীরে/ বড় বড় অস্থি সন্ধি/ অস্ত্রোপচার/ আঘাত বা দুর্ঘটনা পরবর্তী অস্বাভাবিক/ খতনা বা মুসলমানি পরবর্তী এবং সর্বোপরি পারিবারিক ইতিহাস।
হিমোফিলিয়ার ধরন:
১। স্বল্প মাত্রার হিমোফিলিয়া: (ফ্যাক্টর মাত্রা >৫.০%)
২। মধ্যম মাত্রার হিমোফিলিয়া: (ফ্যাক্টর মাত্রা ১.০-৫.০%)
৩। মারাত্মক মাত্রার হিমোফিলিয়া: (ফ্যাক্টর মাত্রা <১.০%)
মারাত্মক মাত্রার হিমোফিলিয়া রক্তক্ষরণ সাধারণত জখম বা আঘাতের পর পরই শুরু হতে পারে।
পরীক্ষা নিরীক্ষা:
রক্তের সিবিসি (CBC) বিটি (BT)/ পিটি (PT)/ এপিটিটি (APTT)/ ক্লটিং ফ্যাক্টর ৮ ও ৯ (Factor VIII/Factor IX) আ্যসে।
চিকিৎসা:
পরিতাপের বিষয় হলো এর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল দুষ্প্রাপ্য ও আমাদের দেশে অপ্রতুল মূলত রাজধানী কেন্দ্রিক।
মাত্রাও ক্ষেত্র বিশেষে এর বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে। যেমন-১। চাহিদা সাপেক্ষে ফ্যাক্টর প্রতিস্থাপন- যেটি আমাদের দেশে প্রচলিত চিকিৎসা। ২। একটানা প্রোফাইলেক্সিস/ নিয়মিত ফ্যাক্টর প্রতিস্থাপন চিকিৎসা- অন্তত ৪৫ সপ্তাহ/ প্রতি বছর- বেশির ভাগ উন্নত দেশে বর্তমানে প্রচলিত) এটির আবার অস্থি সন্ধি আক্রান্তের অবস্থান ভেদে প্রাইমারি/ সেকেন্ডারি/ টারশিয়ারি প্রোফাইলেক্সিস ৩ স্তরে এ ভাগ করে শুরু করা হয়।
৩। ইপিসোডিক ফ্যাক্টর প্রতিস্থাপন-শল্য চিকিৎসা অথবা অস্থিসন্ধির ব্যায়াম পূর্ববর্তী/কালীন ফ্যাক্টর প্রতিস্থাপন
চিকিৎসা উপকরণ:
১. CFC: (Clotting Factor Concentrates)
a) Recombinant CFC
b)Extended Half life CFC
c) Pooled Factor Concentrate
d)Cryo-Precipitate
e) Fresh Frozen plasma
f) Prothombin Complex Concentrates (3 Factors/4 Factors)
g) Fresh blood
h) Anti Fibrinolytic agents etc.
২.Bi-Specific Agents/TAFI (Thrombin Activatable Fibrinolytic inhibitors)- Updated
CFC প্রতিস্থাপন হিমোফিলিয়ার প্রধান চিকিৎসা হলেও অন্যান্য উপকরণ ক্ষেত্র বিশেষে প্রযোজ্য।
সেই CFC আমাদের দেশে তৈরি হয় না পাশ্চাত্য/ ইউরোপের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এগুলো তৈরি করে। এমনকি আমাদের দেশে অদ্যাবধি কেউ আমদানিও করে না বিধায় আমাদের হিমেফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসায় শুধু মাত্র FFP বা রক্ত পরিসঞ্চালনই ভরসা।
হিমেফিলিয়া সোসাইটির সূত্র মতে এ পর্যন্ত ৩৬০০ এর উপরে রোগী শনাক্ত করা গেলেও বিশ্ব হিমোফিলিয়া সংস্থার হিসেবে আমাদের দেশে এর সংখ্যা ২০০০০ এর মত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইতিমধ্যে ৪৫০ জনের উপরে রোগী শনাক্ত করা গেলেও তাদের চিকিৎসা FFP/Fresh blood নির্ভর। তবে চমেক হেমাটোলজি HTC (Haemophilia Treatment Center) বিশ্ব হিমোফিলিয়া অধিভুক্ত হওয়ায় তাদের মানবিক সাহায্য সহায়তা তহবিল থেকে প্রাপ্ত কিছু CFC জরুরি চিকিৎসার জন্য পেয়ে আসছে। এই বিভাগ তাদের আন্তর্জাতিক হিমেফিলিয়া গবেষণায়ও সম্পৃক্ত।
সম্প্রতি চমেক হেমাটোলজি বিভাগের গবেষণা সম্পর্কিত HTC এর বিশ্ব হিমোফিলিয়া সংস্থার সহিত আন্তর্জাতিক গবেষণায় সম্পৃক্ত হওয়া আর্টিকেলটি ISTH এর জার্নাল Research and Practice Journal of Thrombosis & Haemostasis এ প্রকাশিত হয়েছে। হিমোফিলিয়া যেহেতু শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক নয় কিংবা দারিদ্রতার কষাঘাতে রোগীরা রাজধানীমুখীও হতে পারে না। তাই এইবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘চিকিৎসা সবার নায্য অধিকার নিশ্চিতকরণে এতদ সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি তথা রক্তরোগ বিভাগের জনবলসহ অবকাঠামো স¤প্রসারণের মাধ্যমে হিমোফিলিয়া রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা সময়ের দাবি।
পূর্বকোণ/এসএ