চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

হঠাৎ মৃত্যুভয় এক অদ্ভুত মানসিক রোগ

অনলাইন ডেস্ক

২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ১:১৭ অপরাহ্ণ

এক.

আপনি বসে আছেন বা রাস্তায় হাঁটছেন, ধরুন হটাৎ একটি বিষাক্ত সাপ সামনে পড়ে গেল। দেখলেন, সে ফনা তুলে আপনার দিকেই এগুচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনি দৌড় দিয়ে পালাতে গিয়ে দেখলেন আপনার হাত-পা অবশ। আপনি নড়তে পারছেন না, ছুটতে পারছেন না! এভাবে কয়েক মিনিট। তখন আপনার মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, ভেবে দেখুন তো?

এমন পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে আপনার হার্টবিট বাড়তে থাকবে, আপনি ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকবেন, আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকবে, সারাদেহে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাবে, আপনি ঘামতে থাকবেন, চোখে ঝাপসা দেখবেন, ব্রেইন কাজ করবে না, সব শূন্য মনে হবে, গলা মুখ শুকিয়ে যাবে, নিশ্চিত মৃত্যুর ভয় আপনাকে গ্রাস করে ফেলবে। হয়তো বা অচেতন হয়ে ধপাস করে পড়ে যাবেন।

আসন্ন বিপদে আমাদের শরীর ও মনের এমন প্রতিক্রিয়াকে বলে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ রেসপন্স।

এই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স ন্যাচারাল। সর্বশক্তিমান আল্লাহ অথবা যে নামেই ডাকুন, তিনিই বিপদের সময় আমাদের ব্রেইন ও দেহে এই রেসপন্স স্বয়ংক্রিয় হবার পদ্ধতি রেখেছেন। এই রেসপন্সের জন্য হয় আমরা বিপদে ‘প্রাণপণে লড়াই করি’ না হয় বিপদ থেকে ‘সরে পড়ি’।

আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ব্র‍্যাডফর্ড ক্যানন সর্বপ্রথম ১৯১৫ সালে তার মেডিকেল বিষয়ক বিখ্যাত ‘বডিলি চেইঞ্জেস ইন পেইন, হাংগার, ফিয়ার, এন্ড রেজ’ বইয়ে এই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স ব্যাখ্যা করেন।

এই রেসপন্স আমরা প্রচুর শক্তি যোগায় এবং বিপদ মোকাবেলা করি। এ সময় আমাদের ব্রেইনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্বাভাবিক পরিমাণে এড্রিনালীন (Adrenaline/Epinephrine) নামক একটি হরমোন (স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি) নিঃসৃত হয় এবং এর প্রভাবেই আমাদের শরীর ও মনে শক্তি আসে। বিপদকালীন সময়ে এ হরমোন নিঃসৃত হয় বলে একে বিপদকালীন হরমোন।

দুই.

এখন ধরুন আপনি বসে আছেন বা হাঁটছেন। আপনার সামনে কোন সাপ নেই, বিচ্ছু নেই, বাঘ নেই, নেই কোন বিপদ বা বিপদের আশঙ্কা। সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু হটাৎ করে আপনার দেহ-মনে শুরু হয়ে গেল ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স। তাহলে কি হবে?

আপনি অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকবেন, আপনার পালপিটিশন বাড়তে থাকবে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকলো, ঘামতে থাকলেন, ধীরে ধীরে মৃত্যু ভয় আপনাকে গ্রাস করে নিল।

চমৎকার শান্ত নিরব পরিবেশে কোনোরূপ বিপদ আপদের আশঙ্কা ছাড়াই যদি আপনার দেহ মনে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স (Fight or Flight Reaponse) স্বতঃস্ফূর্তভাবে চালু হয়ে যায়, তবে সেই অবস্থাকে নিউরো-সাইকিয়াট্রির পরিভাষায় বলে ‘প্যানিক এটাক’ ( Panic Attack)। আর যদি জীবন চলার পথে প্রায়ই আপনার এমন হয়, তাহলে তাকে বলে প্যানিক ডিসওর্ডার (Panic Disorder)।

আসুন জেনে নেই, প্যানিক অ্যাটাক বা প্যানিক ডিসওর্ডার কি?

প্যানিক অ্যাটাক

কোনো কারণ ছাড়াই হটাৎ স্বল্প সময়ের জন্য দেহ-মনে তীব্র ভয়ের উদ্রেক হওয়া এবং তার ফলে নিউরো-সাইকিয়াট্রিক কিছু উপসর্গ দেখা দেয়াকে বলে প্যানিক অ্যাটাক। আমাদের সমাজে প্রচুর মানুষ আছেন, যারা প্যানিক অ্যাটাক বা প্যানিক ডিসওর্ডারে ভোগেন কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেন না। আর বললেও কেউ বিশ্বাস করেন না। সবাই হেসে উড়িয়ে দেন কিংবা জ্বীন-ভুতের আছর বলেন।

প্যানিক অ্যাটাকের শারীরিক ও মানসিক যে সকল উপসর্গ দেখা দেয় তা হলো নিম্নরূপ,

বুক ধরফর করা,
ঘেমে যাওয়া,
শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হতে থাকা,
শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে যাবার মতো অবস্থা
হাত পা কাঁপতে থাকা,
বুকে চাপ অনুভূত হওয়া,
মাথা ঘোরানো, ঝিম ঝিম, মাথায় শূন্যতা সৃষ্টি,
সারা গা বেয়ে ঝিনঝিন শিনশিন করে অনুভূতি উঠা,
নিজেকে বাস্তবতা থেকে হারিয়ে ফেলা এবং
এই বুঝি হার্ট এটাক হয়ে মরে গেলাম, এ রকম মনে হওয়া।

প্যানিক অ্যাটাক রোগীর মধ্যে খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না। সাধারণত উপসর্গ হঠাৎ শুরু হয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় এবং তা মাত্র ১৫/২০ মিনিট স্থায়ী থাকে। এরপর ধীরে ধীরে রোগী স্বাভাবিক হয়ে যায়। রোগী আগের মতো চলাফেরা করতে পারে। মূলত: এই উপসর্গগুলো মনের ভুলে হয়।

প্যানিক অ্যাটাকে যা হয়

পুরো ব্যাপারটি অল্প সময়ের জন্যে হলেও এ অবস্থা একজন রোগীর জন্যে ভয়ানক যন্ত্রণার। প্যানিক অ্যাটাক যাদের হয়, একমাত্র তারাই এর যন্ত্রণা বোঝেন। কারণ এ সকল মানসিক ও শারীরিক উপসর্গ কয়েক মিনিট থাকা মানেই একজন সাধারণ মানুষের জন্য ভীষণ বিভীষিকাময়!

অনেকে আবার প্যানিক অ্যাটাককে ভুল ভেবে মনে করেন তার হার্ট এটাক হচ্ছে, বা এজমা রোগ দেখা দিয়েছে। যদিও প্যানিক এটাকের সময় রোগী মনে করেন যে, তিনি এই বুঝি মারা যাচ্ছেন, কিন্তু আসলে প্যানিক ডিসওর্ডার রোগে কেউই মারা যান না।

প্যানিক ডিসওর্ডার কি

একজন মানুষের মধ্যে যখন বারবার প্যানিক অ্যাটাক দেখা দেয় কিংবা প্যানিক অ্যাটাক হবে—এই ভেবে সারাক্ষণ যখন একজন মানুষ প্রায়ই ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন, তখন এ অবস্থাকে বলে ‘প্যানিক ডিসওর্ডার’।

অনেকের আবার প্যানিক অ্যাটাক হয় নির্দিষ্ট কোন গেলে। এমন স্থান, যেখান থেকে থেকে সহসা বের হওয়া সম্ভব না। যেমন,

ভীড়, কোলাহল, জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান স্থল, ক্লাব, মার্কেট, বাজার, শপিং মল, বদ্ধ ঘর বা আবদ্দ হল ঘর, জনাকীর্ণ বিয়েবাড়ি বা কমিউনিটি সেন্টার, লিফটের ভিতর, এলিভেটরে, প্লেন, ট্রেন, বাস বা স্টিমারের ভিতর, উঁচু দালানের ছাদে গেলে
কিংবা কোন উঁচু ব্রিজে উঠলে।

এ সকল স্থানে গেলে রোগীর প্যানিক অ্যাটাক হয় বলে তিনি এসব জায়গা এড়িয়ে চলেন। এ অবস্থাকে বলে ‘প্যানিক ডিসওর্ডার উইথ এগোরা ফোবিয়া’। (Panic Disorder with Agoraphobia)।

এগোরাফোবিয়া কি?

এগোরাফোবিয়া হলো গ্রিক শব্দ। গ্রিক ‘অ্যাগোরা’ শব্দের অর্থ জনাকীর্ণ বা কোলাহলে পরিপূর্ণ স্থান বা মার্কেট প্লেস বা এসেম্বলি প্লেস। আর ‘ফোবিয়া’ অর্থ ভয়। অর্থাৎ জনাকীর্ণ বা কোলাহলপূর্ণ স্থানে যেতে ভয় বা গেলে ভয়।

প্যানিক ডিসওর্ডারের জন্যে অনেক রোগী প্লেন চড়েন না। বারবার প্লেনে বা ট্রেনে চড়ে যাত্রার আগেই ভয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসেন। আমি এমন অনেক রোগী পেয়েছি।

এর চিকিৎসা আছে?

হ্যা, এ রোগের কার্যকরী চিকিৎসা রয়েছে। এই মানসিক (নিউরো-সাইকিয়াট্রি) রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাময় সম্ভব।

কি চিকিৎসা?

সাইকোথেরাপি, রিলাক্সেশন থেরাপি, কার্যকরী মাত্রায় সেরোটোনিন রি-আপটেক ইনহিবিটর (SSRI) মেডিসিন অত্যন্ত কার্যকরী। ওষুধ সেবন ও সাইকিয়াট্রিস্ট কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাইকোথেরাপিতে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে যাপন করতে পারেন। সূত্র: মেডি ভয়েস

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট