চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

আত্মহনন প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

ড. নিয়াজ আহমেদ

১৬ নভেম্বর, ২০২৩ | ৮:২০ অপরাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহননের প্রবণতা বেড়ে চলছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে কমবেশি এ প্রবণতা লক্ষণীয়। মোটাদাগে আত্মহননের পেছনে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা বড় নিয়ামক। মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা বিচ্যুত না হলে একজন মানুষ নিজেকে হনন করতে পারে না।

মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে সামাজিক বিচ্যুতি বেশি মাত্রায় কাজ করে। সমাজে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে বসবাস করতে হলে একটি ভালো সামাজিক পরিবেশ থাকা দরকার। এখানে সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক থাকবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুচারুভাবে কর্মসম্পাদন করবে।

এদের মধ্যে পরিবার অন্যতম। সুশৃঙ্খল পরিবার এবং সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ পারে একজন মানুষের জীবনকে ভালোভাবে পরিচালিত করতে। এখানে যদি ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে তা পূরণ করা যায় না। ঘাটতি পূরণ করে কতগুলো উপাদান, যা তাকে এমন একটি জগতে নিয়ে যায় যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।

তাই বিশ্বব্যাপী পরিবারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে পরিবারই প্রথম, পরিবারই প্রধান। কেননা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা অন্যতম। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, পরিবার যেমন মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখে আবার পরিবারই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার জন্য দায়ী। একটি অন্যটির পরিপূরক। সুশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ আমাদেরকে ভালো করতে পারে, তেমনি ভঙ্গুর পরিবার এবং এর পরিবেশ একটি সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার জন্য দায়ী। শোবিজ জগতের হোমায়রা হিমু কিংবা তাজিনই নয়, কেস হিস্ট্রি নিলে আমরা দেখতে পাব এমন অনেক আত্মহননের পেছনে বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ কতটা দায়ী।

আমেরিকান একজন সাহিত্যিক বোস্টনের এক শহরতলিতে জন্ম নেওয়া সিলভিয়া প্লাথ যখন তরুণ বয়সে নিউ ইয়র্ক শহরে আসছেন তখন অদ্ভুত এক বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন। মধ্যবিত্ত ঘরে যেসব বস্তুগত অপ্রাপ্তির সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে, নতুন শহরে সেসব অপ্রাপ্তি ঘুচে গেলেও কিছু অপ্রাপ্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বড্ড তাড়া সবার, কিসের পেছনে যেন সবাই ছুটে চলছে। সবার আচরণ এবং চিন্তা-ভাবনা, সবই কেমন মেকি, কঠিন এবং স্বার্থান্বেষী। তিনি অনেক আগে আমেরিকান সমাজ সম্পর্কে এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু অনেক আগে না হলেও অধুনা আমরা যেন ছুটছি আর ছুটছি। আগে আমাদের সমাজ এমনটি ছিল না। আমরা অল্পতে তুষ্ট থাকতাম।

আমরা ছুটছি কেউ টাকার জন্য, কেউ খ্যাতি কিংবা যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি আবার অনেকে সামাজিক মর্যাদা ও পদ-পদবির জন্য। যেকোনোভাবেই হোক সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। সমাজকে নীরবে কিছু দেওয়া কিংবা কাজ করার মধ্যে আমি নেই। আমরা প্রকাশ ও প্রমাণের ভঙ্গিতে আছি। ফলে অনেকের মধ্যে একটি তীব্র প্রতিযোগিতা কাজ করে। লেখাপড়ার প্রতিযোগিতা, অর্থসম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা এবং সম্মান ও মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় আমরা কেউ সফল হই আবার অনেকে ব্যর্থ হয়ে মানসিক চাপ অনুভব করি। দেখা দেয় মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাও নেই। যেটুকু আসে তার সাহায্যও আমরা অনেকে নিচ্ছি না। এমনকি আমরা সমস্যাকে সমস্যাও মনে করছি না। প্রচণ্ড চাপকে যখন একা মোকাবেলা করতে পারছি না এবং কারো সাহায্যও নিচ্ছি না তখন নিজের কাছে নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছি। নিজেকে ভালোবাসতে পারি না। তখন অন্য কোনো উপায় থাকে না। বেছে নিই আত্মহননের পথ।

আমাদের মধ্যে অনেকে পরিবার ব্যবস্থার বাইরে বসবাস করি। বৈবাহিক সম্পর্কে না জড়ানো কিংবা মা-বাবার মৃত্যুর কারণে এমনটা হয়। আবার পরিবারে বসবাস করলেও পারিবারিক অসংগতি কিংবা বিশৃঙ্খলায় আমাদের অনেক সন্তানের বসবাস। এমনও আছে, ভালো পারিবারিক পরিবেশে থাকলেও সন্তানদের ওপর অনেক কিছু আমরা চাপিয়ে দিই। তাদের মতামত এবং পছন্দ-অপছন্দকে আমরা আদৌ মূল্যায়ন করি না। বিপরীতও রয়েছে সন্তানদের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে তারা ভিন্ন এক ধ্যান-ধারণা নিয়ে বড় হয়। তখন তাদের মধ্যে বিচ্যুতমূলক আত্মহনন প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বআচরণ সহজে লক্ষণীয় হয়ে পড়ে।

সব ধরন সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য সহায়ক নয়। কেননা এখানে অনেকের পক্ষে সমাজের বিভিন্ন অবস্থা ও ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে সমস্যা হয়। কেননা সমযোজনের কৌশলগুলো তারা পরিবার থেকে আয়ত্ত করতে পারেনি। বিদ্যমান ধরনের জন্য অনেকের পক্ষে একা থাকার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। আবার অনেকে পরিবারে থাকার পরও মানসিকভাবে সে একা থাকে। সুশৃঙ্খল জীবন মানে এমন একটি পরিবেশে থাকা, যেখানে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের খোলামেলা সম্পর্ক ও ভাবের আদান-প্রদান হবে। এমন পরিবেশে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা কম থাকে। অনেক সময় আমরা একে অপরকে বুঝতে পারি না। এমনকি বোঝার চেষ্টাও করি না। মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে বিবেচনাও করি না। ফলে ছোট ছোট সমস্যা যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন তা মেকাবেলা করা একার পক্ষে কঠিন হয়। হিতাহিত জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলি। বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়।

এককথায় সুশৃঙ্খল জীবন ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ভালো পরিবার ও পারিবারিক পরিবেশ থাকার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন কারণে আজ আমাদের অনেককে শারীরিকভাবে সাময়িক কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন্য একা থাকতে হচ্ছে। কিন্তু একা থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। পরিবার না থাকলেও একজন ভালো বন্ধু কিংবা নিজেকে এমন কিছু গঠনমূলক কাজে যুক্ত করা উচিত, যাতে কোনোভাবেই যেন নিজেকে একা মনে না হয়। প্রয়োজনে পেশাগত সাহায্যেরও আশ্রয় গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনোভাবেই উচ্ছৃঙ্খল কোনো কাজে নিজেকে জড়ানো যাবে না। পৃথিবী অনেক সুন্দর। আর জীবন আরো সুন্দর ও আনন্দের। একে কোনোভাবেই অপ্রাকৃতিকভাবে শেষ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আসুন, আমরা সবাই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিই এবং ভালো থাকি। আত্মহননের পথ থেকে নিজেকে দূরে রাখি।

লেখক: ড. নিয়াজ আহমেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট