চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

আইএমএফ’কে খুশি করার বাজেট চাই না

সৈয়দ নাসির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক; এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ এপ্রিল, ২০২৪ | ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের রাজস্ব আহরণ বনাম জিডিপি অনুপাত পাশের দেশ সমূহের তুলনায় কম। এই যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর ভ্যাট, আয়কর ও আমদানি শুল্ক তথা সর্বক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যেনতেনভাবে ট্যাক্স আহরণ করছে। এদিকে আইএমএফ/ বিশ্ব ব্যাংকও ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বেশি করার ওপর সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে।

 

এমন চাপে সরকার জনস্বার্থে যেসব প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর কর অব্যহতি দিয়েছিল সেসব কর অব্যহতি ও ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এমনকি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য প্রত্যেকটি পণ্যের উপর ভ্যাট, ভিডিএস, টিডিএস ইত্যাদি বিভিন্ন নামে কর আরোপ করছে। ফলে বাজারে পণ্য মূল্য কোনক্রমেই কমতে পারছে না। তাই আইএমএফ/ বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে দেশজ অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়নের জোর দাবি জানাই। আইএমএফকে খুশি করার বাজেট চাই না।

 

আসন্ন জাতীয় বাজেট ২০২৪-২০২৫ প্রসঙ্গে পূর্বকোণ প্রতিনিধির সাথে ‘বাজেট ভাবনা’ নিয়ে আলোচনায় এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে, গ্যাসের মূল্য। ইউনিট প্রতি ১২ টাকা রেটের গ্যাসকে করা হয়েছে ৩০ টাকা। তথাপিও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। যদিও বা ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়ার আশায় দাম ৩ গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও, উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে তা মেনে নিয়েছিল।

 

এছাড়া গত বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে ৫% করে ৩ মাসে ১৫% বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ানো হয়েছিল এবং এই বছর ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় ১০% হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এলেও এটুকু বলতে পারি যে, নিকট অতীতে এইরূপ ঘনঘন ও অত্যাধিক হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে পড়ছেনা।

 

ডলার রেট প্রসঙ্গে সৈয়দ নাসির বলেনম ২০২২ সালের এপ্রিলে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দর্শিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। ৮৫ টাকার ডলার এখন ১২০ টাকা। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হয় টাকার। সহজভাবে বুঝার জন্য বিষয়টি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, মনে করুন আমার কাছে ছিল ৮৫ লাখ টাকা। এই ৮৫ লাখ টাকায় আমি পূর্বে ১ লাখ ডলার ক্রয় করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে এই ৮৫ লাখ টাকায় আমি এখন ৭০ হাজার ডলার ক্রয় করতে পারছি। অর্থাৎ টাকার পরিমাণ ঠিকই থাকল কিন্তু আর্ন্তজাতিক পরিসরে ডলারের বিপরীতে এই টাকার মান কমে গেল ৩০ হাজার ডলার বা ৪০%।

 

এই যে টাকার মান ৪০% কমে যাওয়া, এটা আমার জানামতে এই দেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে টাকার সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন। এটার প্রত্যক্ষ কুফল হচ্ছে, আমদানি নির্ভর এই দেশে সব পণ্যের মূল্যই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা এবং সাধারণ জনগণ উভয়ই এই অভিঘাতে চিড়ে-চ্যাপটা হয়ে গেছে।

 

ব্যাংক লোন প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ইতোপূর্বে আমাদের ব্যাংকের সুদের হার ছিল ৯% কিন্তু গত বছর বাজেটের পরে অর্থাৎ জুলাই-২০২৩ থেকে তা বেড়ে এখন ১৪% হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের ব্যবসায়ীদের কস্ট অব ফান্ড ৫৫% বেড়ে গেছে। সে হিসেবে আগে ১ কোটি টাকায় ৯ লাখ টাকা সুদ দিতে হলেও এখন দিতে হচ্ছে ১৪ লাখ টাকা। এটাও ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক বিষয়।

 

কাস্টমসে পণ্যের অ্যাসেস্মেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ প্রসঙ্গে সৈয়দ নাসির বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সব কাঁচামাল ও পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। ফলে এনবিআরও পোর্ট স্টেজে বেশি রাজস্ব আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে সমস্ত কাঁচামাল ও পণ্যের দাম পুনরায় অস্বাভাবিক রকম কমেও গিয়েছিল। কিন্তু এনবিআর পোর্ট স্টেজ-এ অ্যাসেস্মেন্ট ভ্যালু না কমানোয় অর্থাৎ ২০২২ এর অ্যাসেস্মেন্ট ভ্যালুতে কর নির্ধারণ করায় সমস্ত কাঁচামাল ও পণ্যে অতিরিক্ত কর আরোপ করে অত্যাধিক রাজস্ব আদায় করার কারণে দেশের বাজারে কোন পণ্যের দামই কমতে পারেনি।

 

উদাহারণ স্বরূপ, রমজানে খেজুরের আন্তর্জাতিক মূল্য ছিল প্রতি কেজি ১ ডলার এবং ডিউটি ছিল ১০%। কিন্তু এনবিআর যেনতেনভাবে ট্যাক্স আহরণ করার জন্য খেজুরের ট্যাক্স ভিত্তি মূল্য ৪ ডলার করে ধরে এবং ডিউটি ৫৮% আরোপ করায় ২৭৯ টাকা ট্যাক্স বেশি দিতে হয়। ফলে খেজুরের প্রকৃত দামের দ্বিগুণ দামে দেশের ক্রেতা সাধারণকে খেজুর কিনতে হয়েছে।

 

এসব কারণে দেশে সবসময় মূল্যস্ফীতি উচ্চহারে বিদ্যমান রয়েছে। যার কারণে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজছে। মূল্যস্ফীতি উচ্চহারে ও দীর্ঘদিন বজায় থাকলে কোন দেশের অর্থনীতি সুস্থভাবে বাড়তে পারে না। এটা অনেকটা ডায়াবেটিক রোগের মত নীরব ঘাতক একটা ব্যধি। যা দেশের পূরো অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়।

 

মেগা প্রকল্পে বিদেশি লোন বিষয়ে সৈয়দ নাসির বলেন, রাজনৈতিক করণে প্রতি বছর বাজেটের সাইজ বড় করা হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের নামে উচ্চ সুদে ও কঠিন শর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রমাগত লোন নেওয়া হচ্ছে। ফলে রাজস্ব আহরণের ওপর ভয়াবহ চাপ বাড়ছে। এই চাপ চূড়ান্তভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও জীবনমানের উপর পড়ছে। তাই অপ্রয়োজীয় মেগা প্রকল্প বাদ দেওয়া এবং কর হার যৌক্তিককরণের দাবি জানাই।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট