চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

আইয়ুব বাচ্চু শুধুই অন্তর্জালে
ফাইল ছবি

আইয়ুব বাচ্চু শুধুই অন্তর্জালে

তাসনীম হাসান

১৯ অক্টোবর, ২০২৫ | ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ

ঝরাপাতার উড়াউড়ি। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সেই সব পুরনো পাতার মতোই যেন বিবর্ণ কবরটাও। নেমপ্লেটহীন, অচেনা। অথচ সেই কবরে শুয়ে আছেন এমন এক মানুষ, যাকে এক নামেই চিনতো পুরো বিশ্ব! কবরের উপরে আছে শুধু গাছের অজস্র ছায়া, নেই কোনো ফুলের তোড়া, নেই কোনো শোকবার্তা। এসব দেখে কে বলবেন- প্রবাদপ্রতীম শিল্পীর চলে যাওয়ার সাত বছর পূর্ণ হয়েছে এইদিন।

 

গত শনিবার বিকেল নামার মুখে চট্টগ্রাম নগরের চৈতন্যগলির বাইশ মহল্লার কবরস্থানে গিয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত গিটারবাদক, ব্যান্ড মিউজিক জগতের অন্যতম পথিকৃৎ আইয়ুব বাচ্চুর কবরটা আবিষ্কার করা গেল-ঠিক এভাবেই। নিঃশব্দ, অনাড়ম্বর, অবহেলিত- বড় নীরবেই পেরিয়ে গেল শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী। শিল্পীকে খুব দ্রুতই কি ভুলে গেলেন তাঁর শহরের মানুষ, ভক্তকুল! এখন তিনি যেন কেবল বেঁচে আছেন অন্তর্জালে, তাঁর অসংখ্য গানের ভিড়ে!

 

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর আইয়ুব বাচ্চু মারা যাওয়ার পর প্রথম চার বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কবরে অনেকে আসতেন। দিতেন ফুলেল শ্রদ্ধা। কেউবা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে করতেন দোয়া-জেয়ারত-মোনাজাত। অনুষ্ঠিত হতো শহরজুড়ে স্মৃতিচারণের নানা আয়োজনও। কিন্তু তিন বছর ধরে পরিবারের পক্ষ থেকে মিলাদ মাহফিলটাই শুধু হচ্ছে। এবারও সেই মাহফিল হলো, গতকাল বাদ আসর।

 

আইয়ুব বাচ্চুকে ‘ভুলে যাওয়ার’ এমন দৃশ্য দেখে শিল্পীর ফুফাত ভাই মোহাম্মদ হামিদ হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন, কোথায় সেই ভক্তরা? কারও কি একটা ফুল দেয়ার সময়ও হয় না। কোথায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো-কারও কি মনে পড়ল না নিজেদের শহরকে সারাবিশ্বের কাছে গর্বিত করা কৃতী সন্তানকে।

 

আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রাম শহরে এনায়েতবাজার এলাকায়। বেড়েও উঠেছেন বন্দরনগরীর আলো-হাওয়ায়। এরপর আশির দশকে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে জন্মস্থান চট্টগ্রাম ছেড়েছিলেন শিল্পী। অভাবনীয় মেধা ও প্রতিভা সঙ্গে নিয়ে রাজধানী শহরে গিয়েছিলেন আলো ছড়াতে। গিটারের সুর তুলে, গান গেয়ে চার দশক ধরে আইয়ুব বাচ্চু কাছে টানেন দেশ-বিদেশের অগণিত শ্রোতাকে। মৃত্যুর পর তিনি শেষবারের মতো ফিরে আসেন জন্মস্থানে, কাঠের কফিনে। মায়ের কবরের পাশেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন তিনি।

 

আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিতে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে স্থাপন করা হয়েছিল রূপালি গিটার-ভাস্কর্য। আগে মৃত্যুবার্ষিকীর দিন এই ভাস্কর্যের পাশাপাশি ভক্তদের ভিড় থাকতো এবং আইয়ুব বাচ্চুর কবরেও। এবার সেসবের কোনো কিছু না দেখে মন খারাপ কবরস্থানের পাশের ভাসমান চা দোকানি শাহাব উদ্দিনের। চল্লিশোর্ধ এই যুবক বলেন, ‘আগে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিন তো বটেই, জন্মদিনেও অনেকে তাঁর কবরে দোয়া করতে আসতেন, ফুল দিতেন। কেউবা কবরস্থানের পাশে টাঙাতেন শিল্পীকে নিয়ে নানা লেখা সংবলিত ব্যানারও। কিন্তু কয়েকবছর ধরে কিছুই দেখছি না।’

 

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নজরুল ইসলামও ভেবে পাচ্ছেন না এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সবাই ভুলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চুকে, ‘পাশের দেশ ভারতের আসামে সদ্য প্রয়াত শিল্পী জুবেন গার্গকে ঘিরে শোকের যে উন্মাতাল দেখলাম, সেই দিক দিয়ে আইয়ুব বাচ্চুও তো বড় শিল্পী। তিনি যেভাবে কয়েক প্রজন্মকে গানে গানে বিমুগ্ধ করে গেছেন, সেইসব তো চাইলেও ভক্তরা মন থেকে ডিলিট করতে পারবে না। কিন্তু সেই ভক্তরা এখন কোথায়?’

 

আইয়ুব বাচ্চুর স্বজনেরাও বুঝে গেছেন সময়ের ওপর প্রলেপ পড়তে পড়তে শিল্পীকে ঘিরে থাকা আবেগ-ভালোবাসাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে ভক্তদের। এখন তাই কারও দিকে আর তাকিয়ে থাকতে চান না তাঁরা। আইয়ুব বাচ্চুর ফুফাত ভাই হামিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা এনায়েতবাজার এলাকায় বাচ্চু ভাইয়ের নামে একটি ফটক তৈরির চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আগামী বছর মৃত্যুবার্ষিকী বড় আকারে পালন করতে এরই মধ্যে তাঁর নামে একটি স্মৃতি সংসদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

 

গান-কনসার্ট নিয়ে সারাবছরই দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন আইয়ুব বাচ্চু। সেসব থেকে এক টুকরো অবসর পেলেই চলে আসতেন প্রিয় চট্টগ্রামে। বন্দরনগীরতে পা রেখেই ছুটতেন মায়ের কবরের কাছে। এই সময়টাতে তাই থাকতে চাইতেন সবসময় প্রচারের বাইরে। আইয়ুব বাচ্চু মারা যাওয়ার পরও তাঁকে প্রচারের বাইরে রাখার কাজটা কি করেই যাচ্ছেন শিল্পীর অনুরাগীরা, প্রিয় চট্টলা?

 

নাকি শিল্পীর চাওয়া মতো-অশ্রæ গোপন রেখেই চলেছেন তাঁরা। আইয়ুব বাচ্চু যে বহুদিন আগেই গানে গানে বলে গিয়েছেন, ‘এই রূপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে। সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে…!’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট