চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

জীবন সংগ্রাম নিয়ে দেয়া আবেগঘন স্ট্যাটাসে যা বললেন রোজা

বিনোদন ডেস্ক

৫ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৪:২৫ অপরাহ্ণ

নতুন বছরে বিয়ের খবর দিয়ে ভক্তদের চমকে দিয়েছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান খান। মেকওভার আর্টিস্ট রোজা আহমেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। শনিবার (৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

 

এদিকে, বিয়ের খবর প্রকাশ হতেই তাহসানের নতুন স্ত্রী উম্মে হাবিবা রোজাকে নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে চর্চা শুরু হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, রোজার লেখা বিশাল একটি পোস্ট সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই পোস্টে রোজার সংগ্রামী জীবন, নিউইয়র্ক যাওয়া, মেকওভার আর্টিস্ট হয়ে ওঠার বিষয়টি সামনে এসেছে। এসেছে নেপথ্যের কষ্টের কথা।

 

২০২৪ সালের ৪ জুন আবেগঘন নেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে রোজা লিখেন, আলহামদুলিল্লাহ! এইমাত্র নিউইয়র্ক সিটিতে আমার রোজাস ব্রাইডাল মেকওভার এন্ড বিউটি কেয়ার সেলুনের ডেকোরেশন এবং সেটআপের কাজ শেষ হলো। সেলফিটা একটু আগেই তুলেছি। সাধারণত আমার অনেক ছবি তোলা হয়; কিন্তু আজ এই সেলফিটা তোলার সময় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক সময় ধরে কাঁদলাম। কিন্তু কী মনে করে কাঁদছি বা কেন কাঁদছি তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

 

আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, তাই সবচেয়ে আদরের ছিলাম। আর বাবা আমাকে সবসময় বলতেন, ‘আমার ছোট্ট পরীটা কইরে’। সেই সময় বরিশাল শহরে আমাদের পরিবারের বেশ প্রভাব ছিল। ছোটবেলায় কখনও কমতি পাইনি। এর বাসায় দাওয়াত, তার বাসায় দাওয়াত! আর যেতেই হবে, কারণ আমাদের ছাড়া দাওয়াত অসম্পূর্ণ হবে। এমন দিনও গিয়েছে, দিনে ৪টা দাওয়াতেও অংশ নিয়েছি, শুধু দেখা করে আসার জন্য।

 

হঠাৎ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ওপারে। যতদিনের হায়াত তিনি নিয়ে এসেছেন ততদিন ছিলেন আমাদের সাথে। অভিযোগ তো অনেক জমা আছে বাবার সেই ছোট্ট পরীটার, কিন্তু অভিযোগ কার কাছে করব? আর বাবা শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, সাথে সাথে যে মানুষগুলো আমাদের এত সম্মান করতেন তাদের ভালোবাসাও চলে গেল আমাদের উপর থেকে।

 

আর সেই দিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, যে ভালোবাসা আমরা পেয়েছি তা সবই বাবাকে ঘিরে, আর সাথে অনেক অনেক স্বার্থ। বাবা চলে যাবার ঠিক ২ মাসের মাথায় আমার এক রিলেটিভের বিয়ে। আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম একে অপরের, কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত পেলাম না। যে রিলেটিভরা সেই বিয়েতে অংশ নিয়েছে সবাই ফোন করতে শুরু করল মাকে। কেন আমরা গেলাম না, কোথায় আমরা? বরিশালে আছি কিনা এই সেই। সেদিন সারারাত বসে দেখেছি মায়ের সেই সরল মনের কান্না।

 

আপনারা লেখাটা পড়ে ভাবতে পারেন, দাওয়াত পাইনি বলে কাঁদছি? কিন্তু দাওয়াতের জন্য নয়, একই দালানে সবাই আনন্দ করছে; আমি, মা আর ছোট ভাই উৎস তখন বাসার এক কোণে। খুব চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা তুমি একটু দেখে যাও, যাদের জন্য এত করেছ তারা আমাদের সব ফিরিয়ে দিচ্ছে।

 

বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন, দাদা ভাইয়ের অনেক আছে; কিন্তু কিছুই গোছানো না। কে বুঝেছেন যে এত অকালে উনি চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে! আর দাদার সব সম্পত্তিতেই চাচা-ফুফুদের ভাগ আছে। মায়ের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পাননি। আর আমি চলে আসি তাদের কোলে। আমার মা খুব সরল মনের, দিন দুনিয়ার কিছুই বোঝেন না। তিনি যে নিজের ভয়েস রেইজ করবেন বা তার সেটা রেইজ করার অধিকার আছে সেটা তার ধারণার বাইরে। কখনও তার সেই সাহসটাই ছিল না যে শ্বশুরকে বলবেন, বাবা আমাদের সম্পত্তিটুকু আমাদের বুঝিয়ে দিন। আর উৎস তো তখন অনেক ছোট। আমরা দুই ভাই-বোন তখন পিচ্চি পিচ্চি। আমাদের পড়াশোনার খরচ তখন একদম হিসাব করে টায় টায় দেয়া হতো মায়ের হাতে। তাই কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলতাম না, যাতে উৎস যেটা চায় সেটা সে পায়। আমার দিক থেকে একটু কম হলেও সমস্যা নেই।

 

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রস্তাব আসা শুরু হয়। এই রিলেটিভ একে আনে ঐ রিলেটিভ ওকে আনে। সেই সময় আমি প্রথম ভয়েস রেইজ করেছি যে, আমার বয়স কম; আর বাবা মারা গেছে কি হয়েছে? বাবার আর আমার স্বপ্ন তো মারা যায়নি!

 

ঐদিন কথাটায় খুব মাইন্ড করেছিল আমার কাছের লোকজন। বড়দের মুখে মুখে কথা, আমি আর মানুষ হবো না। আর সেই থেকেই রটানো হয় কত কথা। সারাদিন নাকি ছেলেদের সাথে ঘুরি, আমার বন্ধু-বান্ধব সার্কেল ভালো না, পর্দা করি না- আরও কত কী। মেয়েতো নিশ্চয়ই প্রেম করে, আর না হলে এত ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়? আর প্রতিদিন এভাবেই বাসায় অভিযোগ আসা শুরু করে।

 

আমার মা এত অভিযোগ শুনতে শুনতে বললেন, তুই আমাকে ছুঁয়ে বল এইসব অভিযোগ কি সত্যি। আমি মাকে ছুঁয়ে বললাম, না মা, সব মিথ্যা। আমি তো স্কুল আর বাসা বাদে কোথাও যাই না। এই বলে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম মায়ের সাথে। ওইদিনের পর থেকে মা আমার সাথে নিয়মিত কোচিংয়ে যেতেন; আবার এসে বাসার সবার জন্য রান্না করতে হতো। খুব কষ্ট হয়ে যেত তার। তখন নিজের কাছে মনে হতো আমি সবার জন্য একটা বোঝা, সবক্ষেত্রেই আমার দোষ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ দাদাভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর সেই থেকে আমার সাথে কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করেন মা। কারণ তাদের সেবা-যত্ন করতে হতো মাকেই।

 

তখন থেকেই একা একা চলা শুরু করলাম। একটা ফ্রেন্ড বললো ও স্টুডেন্ট পড়ায়। আমি বললাম, আমাকে একটা খুঁজে দিবি? আমিও শুরু করতে চাই। বেশ, একজন খুঁজতে গিয়ে দুজনকে পেয়ে গেলাম। কেজিতে পড়ে, খুব অল্প টাকা বেতন। আর কোচিংয়ের পড়া আমার ভালো লাগতো না, তাই আমি নিজে নিজে বুঝে পড়তাম। কিন্তু বাসার কথা ছিল কোচিংয়ে পড়তেই হবে। তাই কোচিংয়ের সময়টা আমি স্টুডেন্ট পড়াতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। আর সেই টাকা জমিয়ে উৎসকে ঘুরতে নিতাম, কিছু একটা পছন্দ করলে কিনে দিতাম। বাবার যে আদর আমি পেয়েছি, ও সেই আদর পায়নি; তাই বাবার আদর হয়তো দিতে পারতাম না, তবে কখনও যাতে আফসোস না করে সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতাম।

 

আমাকে যে কথা শুনতে হয়েছে আমি আর একটি মেয়েকেও সেই কথা শুনতে দিতে চাই না। তাই শুরু করলাম মেকআপ ক্লাস। এক বছরে ৫০০+ মেয়েকে মেকআপ শেখালাম। শত শত মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ একদিন মায়ের কল, যুক্তরাষ্ট্র এম্বাসিতে দাঁড়াতে হবে, ইমিগ্রেশন ভিসার জন্য। বড় মামা অনেক আগে থেকে আবেদন করেছিল। দেখতে দেখতে ভিসা হয়ে গেল। উৎস আর মায়ের জন্য দেশ ছাড়তে হবে। একটু একটু করে যুক্তরাষ্ট্রে নিজের অবস্থান তৈরি করেছি।

 

নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সার্কেল আর নিজের স্বপ্ন সব ফেলে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ নিয়ে চলে আসলাম ইউএসএতে। এখানে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানের প্রবাসীরাও আমার কাছে সাজা শুরু করল, ক্লাস করা শুরু করালাম। নিজেকে আবার এই দেশেও একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করালাম। কসমেটোলজির মাধ্যমে স্কিন, হেয়ার এবং মেকআপ রিলেটেড স্টাডি করলাম কলেজে। আর সেখান থেকেই আজকের স্টুডিও। কসমেটোলজির ওপর নতুন করে আবার পড়াশোনা, লাইসেন্স নেয়া সব চ্যালেঞ্জ নতুন করে আবার ফেস করেছি। সেলুনে সব থেকে এক্সপেন্সিভ এবং কোয়ালিটিফুল প্রোডাক্ট দিয়ে সাজিয়েছি সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট।

 

কথাগুলো খুব আবেগ নিয়ে লেখা। শুরুতেই বলেছিলাম আমার মা একজন সরল মানুষ। বাবা মারা যাবার পর জীবনে উচ্চস্বরে কথা বলতে পারেননি, কখনও হাসতে দেখিনি। আর আজ সেই মা উচ্চ গলায় সবাইকে ফোনে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার বড় মেয়ে রোজাই তো আমাকে দেখছে, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন আমাদের।’

 

তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখতে পারেননি, কিন্তু তার মেয়ে হিসেবে একটু হলেও নতুনভাবে বাঁচতে শিখতে সাহায্য করেছি। আজ খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা তোমার সেই ছোট্ট পরীটা অনেক বড় হয়েছে! আমার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু তুমি বাবা।

 

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট