নায়িকা পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন সম্প্রতি ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে আসামি পরীমনি ও তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের বিরুদ্ধে বাদীকে মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে আরেক আসামি ফাতেমা তুজ জান্নাত বনির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যা বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে : এ মামলার ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী তুহিন সিদ্দিকি অমির সঙ্গে জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে মাঝে মধ্যে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ হতো এবং পরস্পরের মধ্যে বাসায় আসা যাওয়া থাকতো। ২০২১ সালের ৮ জুন তুহিন সিদ্দিকি অমি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানী কিংস বেকারী শপে অবস্থানকালে পরীমনির কস্টিউম ডিজাইনার জিম তাকে ম্যাসেঞ্জারে কল করে বনানীর বাসায় যেতে অনুরোধ করে।
বাসায় যাওয়ার পর অমির সঙ্গে পরিমনি এবং ফাতেমা তুজ জান্নাত বনিদের সাক্ষাৎ হয়। এরপর তারা অমির কাছে জানতে চান এত রাতে উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে কিনা।
উত্তরে অমি জানান, রাত বেশি হচ্ছে তাই এখন উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে না। তখন জিমি জানতে চান যে, তাহলে বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে কি না? জবাবে ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে মর্মে জানান অমি। তখন পরিমনির অনুরোধে অমিসহ তারা ৪জন অমির কালো রংয়ের জীপ গাড়িতে করে রাত ১২টা ২২ মিনিটে ঢাকা বোট ক্লাবে আসেন। গাড়ির পিছনে পরিমনির সাদা রংয়ের খালি জীপ গাড়ি বোট ক্লাবে প্রবেশ করে।
ক্লাবের দোতলায় উঠে প্রথমে পরিমনি ও ফাতেমা তুজ জান্নাত বনি বারের সামনে থাকা টয়লেট ব্যবহার শেষে বারের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং বারের ভিতরে টিভির সামনের টেবিলে বসেন। টেবিলে সাক্ষী অমিও বসেন। সৌজন্যতার খাতিরে অমি তাদেরকে স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার নিজ খরচে পরিবেশন করে আপ্যায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিমনি একটি ০১ লিটারের ব্লু-লেবেল মদের বোতল অর্ডার করেন। পরিমনি ও তার সঙ্গে থাকা জিম ও বনি নিমিষেই সেই বোতলের এ্যালকোহল পান করে বোতল খালি করে ফেলেন এবং অনুরূপ আরেকটি বোতলের অর্ডার করেন। তারা ঐ বোতলের আংশিক মদ পান করেন।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : আড্ডার এক পর্যায়ে তাদের ২/৩ টেবিল পিছনে বোট ক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নাছির উদ্দিন মাহমুদকে আরও দুইজন ব্যক্তির সঙ্গে বসা দেখতে পান অমি। তখন অমি পরিমনিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে নাছির মাহমুদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং পুনরায় তাদের টেবিলে এসে বসে মদ্যপান সহ গুল্পগুজব করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে নাছির মাহমুদ ও তার সঙ্গে থাকা আরও দুইজন যখন বার থেকে চলে যাচ্ছিলেন, তখন পরিমনি নাছির মাহমুদকে ডেকে বললেন, ‘ভাই আমি আসলাম, আর আপনি এক্ষনি চলে যাচ্ছেন? আমাদের সঙ্গে আরেকটু বসেন। আসেন কিছুক্ষন গল্প করি।’ তখন পরিমনির অনুরোধে নাছির মাহমুদ ফিরে এসে পুনরায় তার টেবিলে বসেন।
কিছুক্ষণ পরে ড্রিংকস শেষে পরিমনি ওয়েটারকে আরও এক লিটারের ৩টি ব্লু লেবেল মদের বোতল সহ ২ বোতল ওয়াইন পার্সেল দেয়ার জন্য অর্ডার করেন। ওয়েটার তখন পরিমনিকে ২ বোতল ওয়াইন পার্সেল দিলেও ব্লু লেবেল মদের বোতল স্টকে না থাকায় পার্সেল দিতে পারে নাই। তখন পরিমনি ডিসপ্লেতে থাকা একটি ব্লু লেবেল বোতল পার্সেল করে দিতে বললে ওয়েটার জানায় বোতলটি বিক্রির জন্য না এবং ক্লাবের মেম্বার ছাড়া পার্সেল দেয়া যাবে না।
কিন্তু পরিমনি জোর করে ঐ বোতল নিতে চায় এবং টেবিলে হট্টগোল করতে থাকে। পরিমনি উত্তেজিত হয়ে কার্ড হোল্ডার বের করে দুই তিনটি ব্যাংক কার্ড দেখিয়ে বলেন যে, ‘আমি কি ফকির? আমার বিল আমি পরিশোধ করব। আমি এটা নিবই।’ তখন পরিমনির সঙ্গে থাকা ফাতেমা বনি বলে ‘ওনাদের যদি রুলস থাকে, মেম্বার ছাড়া নেয়া যাবে না, তাহলে তুমি নিও না।’
তখন পরিমনি বনিকে থাপ্পর মেরে বলে, ‘আমাকে দেখে কি মাতাল মনে হয়।’ পরিমনির সঙ্গে থাকা জিম তাকে শান্ত করতে গেলে তাকেও পরিমনি থাপ্পর মারে। এক পর্যায়ে পরিমনি খুবই উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর থাকা গ্লাস, এসট্রে, ছোট পেরিয়ার এর বোতল ফ্লোরে এদিক ওদিক ছুড়তে থাকেন। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পরিমনিকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরিমনি আরও ক্ষেপে গিয়ে একটি এসট্রে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারে। যা তার ডান কানের ওপরে মাথায় লাগে।
তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবে পরীমনিকে সঙ্গে করে আনায় অমির উপর রেগে যান এবং বলেন, ‘এরকম বেয়াদব মহিলা নিয়ে কেন ক্লাবে আসেন, কাল আপনার নামে নোটিশ হবে। এক্ষুনই এদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যান।’
তখন জুনায়েদ বোগদাদী জিমিয়ে জিম তেড়ে এসে বাদী নাছির মাহমুদকে গালমন্দ করতে করতে ২/৩ টা কিল ঘুষি মারে। এর পরে আবারও পরিমনি বারের ভিতরে যত্রতত্র গ্লাস ছুড়ে ভাংচুর করতে থাকে। একটি গ্লাস নাছির মাহমুদের বুকে লাগলে তিনি আঘাত প্রাপ্ত হন। তখন নাছির মাহমুদ বোট ক্লাব ত্যাগ করে চলে যান। ক্লাব ত্যাগ করার মুহূর্তে পরিমনিকে ক্লাব ছেড়ে চলে যেতে বলার জন্য ক্লাবের নিচে কর্মরত সিকিউরিটি গার্ডকে নির্দেশ দিয়ে যান। নাছির মাহমুদ আহত অবস্থায় ঐরাতে আড়াইটার দিকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করান।
মদের বিল না দিয়েই চলে যান পরী : বার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সিকিউরিটি গার্ড পরিমনিকে বারবার বললেও তারা যেতে চান নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সিকিউরিটি গার্ড বারের লাইট ও এসি কমিয়ে দেয়। তার পরেও পরিমনি যেতে না চাইলে অমি তাকে বার থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং পরিমনির সঙ্গে থাকা জিম ও সিকিউরিটি গার্ড তাকে ধরে গাড়িতে তুলে দেয়। ক্লাবে তাদের খাওয়া দুই বোতল ব্লু লেবেলের দাম ও সঙ্গে পার্সেলে নেয়া দুই বোতল ওয়াইনের দাম পরিশোধ না করেই তারা ক্লাব থেকে চলে যায়। এই ৪ টি বোতলের দাম ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এছাড়া ক্লাবের বারের ভিতরে গ্লাস, এসট্রে, পেরিয়ার বোতল ভাঙনে আনুমানিক ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন বলেন, মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর থেকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করেছি। বাদীর আনীত অভিযোগের বিষয়ে নিবিড় তদন্ত করে এ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছি। ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আছে, মেডিকেল রিপোর্ট আছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। আমারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ও তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবেদন দাখিল করেছি।
এদিকে মামলাটির বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) প্রতিবেদন গ্রহণ বিষয়ে শুনানির জন্য ধার্য রয়েছে। ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
বাদীর আইনজীবী আবুল কালাম মোহাম্মদ সোহেল বলেন, আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছি, পিবিআই তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন গ্রহণ বিষয়ে শুনানির জন্য ধার্য রয়েছে। আমরা পরীমনিসহ আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করবো।
জানা যায়, ২০২১ সালের ৬ জুলাই ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসানের আদালতে বোট ক্লাবের সভাপতি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। এ মামলার অন্য দুই আসামি হলেন- পরীমনির সহযোগী ফাতেমা তুজ জান্নাত বনি ও জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিম।
মামলায় নাসিরউদ্দিন উল্লেখ করেন, পরীমনি ও তার সহযোগীরা অ্যালকোহল সেবনে অভ্যস্ত। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন নামীদামি ক্লাবে ঢুকে অ্যালকোহল পান করেন এবং পার্সেল নিয়ে মূল্য পরিশোধ করেন না। পরীমনি তার পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে মিথ্যা মামলা করিয়ে হয়রানির ভয় দেখান। ২০২১ সালের ৯ জুন রাত ১২টার পর আসামিরা সাভারের বোট ক্লাবে ঢোকেন এবং দ্বিতীয় তলার ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। পরে তারা ক্লাবের ভেতরে বসে অ্যালকোহল পান করেন।
এতে আরও বলা হয়, বাদী (নাসির উদ্দিন মাহমুদ) ও তার সহযোগী শাহ শহিদুল আলম রাত ১টা ১৫ মিনিটে যখন ক্লাব ত্যাগ করছিলেন, তখন পরীমনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাসিরকে ডাক দেন। তাদের সঙ্গে কিছু সময় বসারও অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে পরীমনি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নাসিরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন এবং একটি ব্লু লেবেল অ্যালকোহলের বোতল বিনামূল্যে পার্সেল দেওয়ার জন্য চাপ দেন। নাসির উদ্দিন এতে রাজি না হওয়ায় পরীমনি তাকে গালমন্দ করেন। নাসির এবং আসামিদের মধ্যে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে পরীমনি বাদীর দিকে একটি সারভিং গ্লাস ছুড়ে মারেন এবং হাতে থাকা মোবাইল ফোনও ছুড়ে মারেন। এতে নাসির মাথায় এবং বুকে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
বাদী মামলায় আরও উল্লেখ করেন, পরীমনি ও তার সহযোগীরা তাকে (নাসির উদ্দিনকে) মারধর ও হত্যার হুমকি দিয়েছেন ও বোট ক্লাবে ভাঙচুর করেছেন। এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পরীমনি সাভার থানায় বাদী নাসির উদ্দিনসহ দুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে মামলা করেন।
পূর্বকোণ/এসি