চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

রুনা লায়লা : সংগীত শ্রোতারা যার কাছে অনেক ঋণী

বিনোদন ডেস্ক

১৭ নভেম্বর, ২০২৩ | ৬:১৮ অপরাহ্ণ

শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশেরই সুবিখ্যাত, সুপ্রতিষ্ঠ এবং চিরকালীন জনপ্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা কিন্তু ভুল কিছু বলেননি। সংগীতের ভুবনে অনেকেই আসে-যায়, তবে শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন করে নেন বিরল যারা। পাকিস্তানের মুলতানে ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর জন্ম নেয়া রুনা লায়লা সেরকমই একজন। গানের কান হওয়ার পর বাঙালি যে শ্রোতা রুনার গান একবার মন দিয়ে শুনেছেন, তিনি নিশ্চয়ই মিষ্টি, তারুণ্যদীপ্ত কণ্ঠটির প্রেমে পড়েছেন এবং জেনেছেন বিরল প্রতিভাধর না হলে আমিনা লায়লা আর সৈয়দ মোহাম্মদ ইমদাদ আলীর অতি আদরের এই সন্তান কোনোদিন সংগীতশিল্পী হতেন না, হতেন নৃত্যশিল্পী।

 

তাই বড়বোন দীনা যখন ওস্তাদ আব্দুল কাদের পিয়ারামের কাছে গান শিখে বড় সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্নসৌধ নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন, তিন কি চার বছরের রুনার তখন অন্য ঘরে একা একা ঘুঙুর পায়ে ছমছমাছম নাচতেই ভালো লাগতো।

 

ঘুঙুর প্রাপ্তির গল্পটাও খুব মজার। সরকারি চাকুরে বাবা তখন করাচিতে বদলি হয়েছেন। এক ছুটিতে ঠিক করলেন কলকাতায় শ্বশুর বাড়িতে যাবেন। শুনে দীনা, রুনা, মুরাদের সে কী আনন্দ! তো অনেকদিন পর নাতি-নাতনিদের পেয়ে নানুও মহাখুশি। তিনজনের হাতে কিছু টাকা দিয়ে নানু বললেন, ‘‘নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নিয়ো।” সেই টাকায় বড় বোন দীনা আর ভাই মুরাদ কী কিনবে তা চূড়ান্ত করার আগেই রুনা ছুটে গিয়ে মা-কে বলেছিল, ‘‘আমি ঘুঙুর কিনবো!” আমিনা লায়লা ভেবেছিলেন, বড় মেয়ে দীনার গানের দিকে বেশি টান আর ছোট মেয়ের টান নাচের দিকে, তাই একজন নিশ্চয়ই সংগীত শিল্পী হবে আর অন্যজন নৃত্যশিল্পী। সেই ভাবনা থেকে দীনার জন্য ঠিক করেছিলেন গানের শিক্ষক আর রুনাকে নাচ শিখতে দিয়েছিলেন করাচি বুলবুল একাডেমিতে। সেখানে চার বছর ধ্রুপদী নৃত্য শিখেছেন রুনা। গানের গ-ও যে তাকে টানবে কেউ তখন বুঝতে পারেনি। সেটা বুঝতে পারার পেছনের গল্পটা আরো মজার।

 

এক বিকেলে ওস্তাদ আব্দুল কাদের পিয়ারামের কাছে গান শিখছে দীনা। রুনার ঘুঙুরের শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। এক সময় মনে হলো দীনা যে গান শিখছে সেই গান রুনাও যেন চাপাকণ্ঠে গাইছে। সুর একেবারে নির্ভুল! ওস্তাদজী তো অবাক- শুনে শুনেই এত নিখুঁত সুরে গাইতে পারে ওইটুকু মেয়ে! ব্যস, পরেরদিন থেকে দীনার পাশে রুনাকেও বসানো শুরু হলো। ওস্তাদজী দেখলেন, দীনা যতটা মনযোগী, রুনা ততটাই চঞ্চল, ছটফটে। তবে একটু শুনলেই হুবহু গাইতে পারে। ফলে ঘুঙুর যতই টানুক, অল্প সময়ে সুরের ভুবনেই ডুবে যেতে হলো। প্রথমবার মঞ্চে ওঠার পর তো ঘুঙুর পায়ে বাঁধার আর সুযোগই পাননি রুনা।

 

সে আরেক নাটকীয় কাহিনি।

 

বড় বোন দীনার বয়স তখন ১০ আর রুনার ৬। দীনা তখন মাঝেমাঝে স্টেজেও গায়। তো এক অনুষ্ঠানে দীনা গাইবে বলে সব ঠিকঠাক। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিনেই ভীষণ ঠান্ডা লেগে গেল দীনার। আয়োজকেরা পড়ে গেলেন বিপদে। বাড়িতে এসে সৈয়দ মোহাম্মদ ইমদাদ আলীকে ধরলেন তারা। তাদের একটাই অনুরোধ- দীনাকে মাত্র একটা গান গাওয়ার জন্য যেন স্টেজে উঠতে দেন। আমিনা লায়লা তাদের বললেন, ‘‘দীনা যেতে পারবে না, আপনারা বরং আমাদের ছোট মেয়ে রুনাকে নিয়ে যান, ও বেশ ভালো গায়।” আয়োজকদের তাতে ঘোর আপত্তি। ছয় বছরের মেয়েটি যে স্টেজে উঠে গাইতে পারবে তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাদের। কিন্তু ছোট্ট রুনা সেদিন শুধু গায়নি, গেয়ে আসর মাত করেই বাড়ি ফিরেছিল।

 

তারপর মাত্র নয় বছর বয়সে রেডিও করাচির ছোটদের গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া, শৈশব না পেরোতেই উর্দু ছবি জুগনু-তে ‘গুড়িয়াসি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি’ গেয়ে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে ক্যারিয়ারের সূচনা, আরো কিছুদিন পর আল্লাহ রাখি ওয়াসি, অর্থাৎ ‘মালিকা-এ তারান্নুম’ নূরজাহানের সুরের সাম্রাজ্যে জ্বলজ্বলে তারকা হয়ে ওঠা পর্যন্তই রুনার যা বয়স বেড়েছে, তারপর তো বয়স বাড়ার সময়ই পায়নি! সেই থেকে শুধু খ্যাতিই বেড়েছে।

 

১৯৭৪ পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তানে। যতদিন ছিলেন, স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। পাকিস্তানের শ্রোতা, দর্শকরা আধুনিক পারফর্ম্যান্স কেমন তা বুঝতে পেরেছিলেন রুনাকে দেখে। করাচি টেলিভিশনে ‘বাজমে লায়লা’ নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। শুধু রুনা লায়লার গানের অনুষ্ঠান। সেখানে পাঁচটি গান গাইতেন রুনা। পাঁচ রকমের পাঁচটি গানে রুনা হাজির হতেন পাঁচ রকমের সাজে। তখন সব নারী শিল্পীই গাইতেন শাড়ি পরে। ধরে নেয়া হতো শাড়ি না পরলে দর্শক পছন্দ করবে না। রুনা সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছিলেন। সে আমলে এমনকি শার্ট-প্যান্ট পরেও গান গেয়েছেন। গানের তালে তালে নাচা দরকার মনে হলে নেচেছেন মনের আনন্দে। ছোটবেলায় সেই যে চার বছর নাচ শিখেছিলেন তা খুব কাজে লেগেছে তখন। দর্শক-শ্রোতারা সেই প্রথম দেখেছেন গান সবসময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না গাইলেও চলে, বরং গানের তালে তালে কেউ নাচলে এবং তাতে সুর বিকৃত না হলে, বেশ ভালোই লাগে।

 

রিয়্যালিটি শো-র রমরমার এ যুগে গান কিন্তু আর শ্রুতি শিল্পের আঙ্গিনায় আবদ্ধ নেই, এখন আর শুধু শিল্পীর কণ্ঠের সুর মরমে পশিলে হয় না, মৃদু নাচে চক্ষু জুড়াইলে তবেই না রিয়্যাল পারফর্মার! তা গত পঞ্চাশ বছরে উপমহাদেশের সঙ্গীত ভুবনে এমন পারফর্মার আর ক’জন এসেছেন?

 

রুনা লায়লাকে নিয়ে গর্ব করে বলার মতো গল্প মনে হয় তার প্রকৃত বয়সের চেয়েও বেশি। কিছু গল্পের সত্যতা কেউ যাচাই করেনি। সেরকমই একটা গল্প- ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী ফারাক্কা সমস্যার সমাধানের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের কাছ থেকে নাকি রুনা লায়লাকে চেয়েছিলেন। আবার কিছু গল্প বাঙালির অস্তিত্বের মতোই সত্য।

 

সেরকম একটা গল্প বলা যাক।

 

‘৭৪-এ রুনা লায়লা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে করাচি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। সে বছরই এক সাংস্কৃতিক সফরে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের হয়ে ভারতে গেছেন। দিল্লি, মুম্বাই (তখন বোম্বে) আর কলকাতায় তিনটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন রুনা। সে এমন মন মাতানো, চোখ ধাঁধানো পারফর্ম্যন্স যে একের পর এক প্লে-ব্যাক গানের অফার আসতে লাগলো।

 

তো কিছুদিন পর আবার মুম্বাই যেতে হলো কল্যাণজী-আনন্দজীর ছবিতে গান গাইতে। রেকর্ডের দিনে রুনা লায়লা মহড়ায় ব্যস্ত। হঠাৎ দেখলেন লাল শাড়ি পরে কে যেন এগিয়ে আসছেন! ভালো করে চেয়ে দেখেন- লতাজী! রুনা লায়লাকে দেখতে চলে এসেছেন সুরের সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর! ছুটে গিয়ে লতাকে পায়ে ধরে সালাম করলেন রুনা। সেই ছবি ছাপা হলো ভারতের প্রথম সারির সব পত্রিকায়- ক্যাপশনে লেখা ‘‘টু নাইটিঙ্গেলস মিট ইচ আদার”!

 

সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ, আরবি, মালয়ালম, নেপালি, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইংরেজিসহ অনেক ভাষায় অনেক গানই গেয়েছেন গানের পাখি রুনা লায়লা। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন, ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। এছাড়া ভারত থেকে সায়গল পুরস্কার, পাকিস্তান থেকে নিগার পুরস্কারসহ বিদেশ থেকেও অনেক স্বীকৃতিই পেয়েছেন তিনি।

 

পাকিস্তানের অনেক মানুষ ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ গানটা এখনো তার কণ্ঠেই শুনতে চান, ভারতে ‘ও মেরে বাবু ছ্যাল ছাবিলা’ শুনলে এখনো নেচে ওঠেন অনেকে, বাংলায় তো কত জনপ্রিয় গান তার- ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘যখন আমি থাকবো না গো’…। অসাধারণ কিছু দেশাত্ববোধক গানও গেয়েছেন। একটা গানের কথা রুনা লায়লার জন্মদিনে না বললেই নয়। গানটি লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান, সুর করেছিলেন খন্দকার নুরুল আলম:

 

‘‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে

পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে

আমার অনেক ঋণ আছে

বকের ডানায় ছাওয়া চরের কাছে

চাঁদ জাগা বাঁশ বাগানের কাছে

আমার অনেক ঋণ আছে।।”

দেশের কাছে রুনা লায়লা এবং সব দেশবাসীই অনেক ঋণী।

আর শ্রোতারা ঋণী রুনা লায়লার কাছে।

শুভ জন্মদিন, রুনা লায়লা! সুরে সুরে বেঁচে থাকুন দীর্ঘকাল! সূত্র: ডিডব্লিইউ

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট