চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিমানের টিকেটের অগ্নিমূল্য

অগণিত আমিরাত প্রবাসীর ঈদ থেকে গেল অধরা

ইউএই প্রতিনিধি

১৪ জুন, ২০২৪ | ১০:১১ অপরাহ্ণ

ঈদের ছুটিতে দেশে যাওয়ার জন্য মন কাঁদছে প্রবাসীর। কিন্তু এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া অধরা থাকায় সে আশাটাই কেবল হচ্ছে সার। ফ্লাইট আছে, টিকেট নাই টিকেটের কচিৎ ছিটেফোঁটা সন্ধান মিললেও তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ধারণা করা হচ্ছে এতোসবের মধ্যে কমপক্ষে দুই-আড়াই লাখ প্রবাসী এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশের উদ্দেশে আমিরাত ছাড়ছেন।

 

দুবাই প্রবাসী ট্রাভেল এক্সিকিউটিভ মঈন উদ্দিন সিদ্দিকি জানিয়েছেন, ১৩ জুন ফ্লাই দুবাইয়ের ফ্লাইটে একটি দুবাই চট্টগ্রামের ওয়ান ওয়ে টিকেট মূল্য ট্রাভেল অপারেটরের কমিশন ছাড়া চাওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৭৭০ দিরহাম বা ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে একই এয়ারলাইন্সে সে ভাড়া ৭-৮ শ দিরহাম। এক্ষেত্রে ভাড়া বেড়েছে ছয় থেকে সাত গুণ! ভাবা যায়?!

 

আবুধাবির ক্যানক্যান ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানে আলম বলেছেন, পুরো ট্রাভেল ব্যবসাকালীন এবারের ঈদুল আযহার মত বিমানের এমন টিকেট ক্রাইসিসের অভিজ্ঞতা তার আর হয়নি। বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিমানের বিশেষ করে ইকনমি ক্লাসের টিকেট মে মাসেই সব সোল্ড আউট হয়ে গেছে। তার কথায় বিমান আবুধাবি দুবাই সারজাহ হতে কমপক্ষে আরও ৪-৫টা করে ফ্লাইট দিতে পারত ক্রাইসিস মোকাবেলার জন্য। কিন্তু ঈদকে ঘিরে ১০ জুন বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিমান কেবল একটি ড্রিমলাইনার ফ্লাইট দেয় মাত্র। তার কথায় এখনো ফ্লাইট দিলে শুধু আবুধাবি থেকেই আড়াই থেকে ৩ হাজার মানুষ দেশে যাবেন। কিন্তু তা করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে স্লট পাওয়ার একটা ইস্যু থাকলেও সেটা অন্য এয়ারলাইন্স পেলে আমার প্রশ্ন বিমান কেন পাবে না। তবে সে মাথাব্যথা কারো থাকলেই তো!

 

তাহলে সত্যিই কি বিমান সিন্ডিকেটের কবলে?

 

এসব ক্রাইসিসকালে বিমান যাত্রীদের একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে দেশের পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স কি তাহলে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের কবলে? অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ে সবসময় সোচ্চার। বিমানের আবুধাবী থেকে সবগুলি ফ্লাইট অপরিসর বোয়িং ৭৩৭। সপ্তাহে ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট মিলে আবুধাবি থেকে সাতটি নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে। এগুলির যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা ১৬২ হলেও বিধিবদ্ধ নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য টেকনিক্যাল কারণে ১৩৬টির বেশি সিট সেল করার নিয়ম নাই। করলে যাত্রীদের ব্যাগেজ অফ করে দিতে হয় তাতে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হন। আমাদের ২২ টি স্টেশনে বিমানকে অপারেট করতে হয় একুশটি এয়ারক্রাফ্ট এর বহর দিয়ে যার মধ্যে ড্রিমলাইনারও আছে যদিও আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে বললেন আবুধাবি ও আল আইনের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিমান এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল ফেরদৌস। তাহলে বিমানের অলাভজনক কিছু সেক্টরে অপারেশন রয়েছে কেন,বাড়তি চাহিদা সত্ত্বেও কেন এখানে সুপরিচিত ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে না বা ফ্লাইটের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো হচ্ছে না এ ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করতে নারাজ এবং বললেন এটা বিমানের ম্যানেজমেন্ট ও ফ্লাইট অপারেশনের এখতিয়ার।

 

যাত্রীরা তাই যারপরনাই সংক্ষুব্ধ:

 

দুবাই প্রবাসী চট্টগ্রামের উত্তর সর্তা নিবাসী সফিউল আজম বললেন, অসহায় আমরা প্রবাসীরা। দেশের রিজার্ভ যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য শুধু প্রবাসীদের দরকার হয় দেশ এবং সরকারের। অন্য সময় না।

 

দুবাইয়ের আরেক প্রবাসী রেমিট্যান্স সৈনিক কামরুল হাসান জানালেন, ইউ এস বাংলা এয়ারলাইনস এর ১৬ জুন এবং ১ জুলাই ফেরার ইকনমি ক্লাসে শারজাহ-চট্টগ্রাম রিটার্ন ফ্লাইট টিকেটের দাম রাখা হয়েছে ৪ হাজার ১২৫ দিরহাম বা ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। যার ভার বহন করা সাধারণ প্রবাসীদের পক্ষে সম্ভব না।

 

নোয়াখালী নিবাসী আবুধাবি প্রবাসী বিপুল খন্দকারে রাখে প্রবাসীদের ভাগ্যের এত অবনতি কেন ঈদের সময় কি বিমানের অকটেনের দাম বেড়ে যায় আপনার মাধ্যমে বিমানের কাছে আমাদের প্রশ্ন ঈদের সময় বিমান ভাড়া বাড়বে কেন? প্রবাসীদের স্বার্থে বিমান ভাড়া কমিয়ে সরকার দেশের মানুষকে ঈদ করার সুযোগ করে দিন এ আবেদন। বিমান সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেশের পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান।

 

আবুধাবি প্রবাসী সাংবাদিক সনজিত শীল বললেন, দুদিন আগে একজনের জন্য একটা এয়ার টিকেট নিলাম ৩ হাজার ৮০০ দিরহামে যা একজন শ্রমিকের চার মাসের বেতন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবুধাবি প্রবাসী শাহীন সিরাজ শ্রাবণ ওসমান প্রকাশ করে বললেন, বাংলাদেশের সাথে বাজেট এয়ারলাইন্স উইজ এয়ার ফ্লাইট চালু করতে চেয়েও পারল না এখানে সিন্ডিকেট।

 

দুবাই প্রবাসী কিশোরগঞ্জ নিবাসী মাসুদুল ইসলাম বললেন, দিনে ১৫ বার টিকেট চেক করি কিন্তু দুঃখের বিষয় হল টিকিটের বাড়তি দামের কারণে দেশে যেতে পারলাম না!

 

চট্টগ্রামের দুবাই প্রবাসী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন হিরন বললেন, সাড়ে ৩ হাজার দিরহামে বিমানের টিকেট করে আসলাম উপায়ান্তর না দেখে।

 

ঢাকা প্রবাসী ওমর ফারুক উসমার কণ্ঠে বললেন, টিকেটের দাম বেশি দেখে কোরবানির ঈদে বাড়িতে যাওয়ার স্বপ্ন মাটি চাপা দিলাম।

 

এ সংকট নিয়ে ট্রাভেল এজেন্টরা কি বলেন:

 

আবুধাবি বিমান অফিস সংলগ্ন ক্যানক্যান ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জানে আলম বিমান আবুধাবি থেকে তিনটি রুটে সপ্তাহে ৭টা ফ্লাইট অপারেট করলেও ফ্লাইটগুলো ছোট এয়ারক্রাফট বোয়িং ৭৩৭ দিয়ে চালায়। এর ধারণক্ষমতা থাকে প্রায় দেড়শ। বিমান ঈদ মৌসুমে কেবল একটিই স্পেশাল ফ্লাইট দিয়েছে যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এই সুযোগে এয়ার আরাবিয়া, ইন্ডিগো, ইউএস বাংলা, শ্রীলংকান এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ, ভিসতারা, গালফ এয়ার ভালই ব্যবসা করে নিচ্ছে। অথচ প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবেগ ও পছন্দের শীর্ষে সব সময় রয়েছে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিমান। যাত্রীরা এখনো প্রতিনিয়ত এসে ধরণা দিচ্ছেন অন্তত বিমানের বিজনেস বা হায়ার ক্লাসে হলেও একটা সিট দেয়ার জন্য আমরা পারছি না এটা আমাদের ব্যর্থতা।

 

দুবাইয়ের আল সাবকা রোডস্থ বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সি আল হিকমা ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুদ্দিন সিদ্দিকী জানিয়েছেন, বর্তমানে এয়ার এরাবিয়া শারজাহ – ঢাকা রুটে দৈনিক চারটি এবং সারজা চট্টগ্রাম রুটে দৈনিক তিনটি করে ফ্লাইট অপারেট করছে। ফ্লাই দুবাই ঢাকা ও দুবাই চট্টগ্রাম রুটে দৈনিক একটি করে ফ্লাইট দিয়েছে। এমিরেটস এয়ারলাইন্স দুবাই ঢাকা রুটে প্রতিদিন তিনটি করে ফ্লাইট অপারেট করছে। এছাড়া সালাম এয়ার, ইউএস বাংলা, ইন্ডিগো, ভিসতারা, কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়া, আল জাজিরা, কুয়েত এয়ার, সৌদি এয়ার, গালফ এয়ার, দুবাই হতে ঢাকায় প্রতিদিন একটি করে সরাসরি বা ভায়া ফ্লাইট অপারেট করছে। চুটিয়ে ব্যবসা করছে তারা। বিমানের তবুও ভাড়া বাড়ানোর একটা সীমারেখা আছে কিন্তু বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়ায় কোন লাগাম টানা হয় না।

 

আর এর মূল্য দিচ্ছে প্রবাসীরা:

 

দেশের বাইরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার এবং রেমিট্যান্স প্রেরণের দিক থেকে বর্তমানে শীর্ষে থাকা দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ লাখ অনাবাসী বাংলাদেশির বসবাস। প্রকৃত অর্থে তাদের নেই কোনো যোগ্য অভিভাবক। প্রবাসে দেশের মন্ত্রীরা আসেন, আমলারা আসেন, নীতি নির্ধারকরা আসেন, প্রবাসীদের শ্রম আর ঘামের অর্থে তারকা হোটেলে সংবর্ধনা নেন কিন্তু দিনশেষে তারা দেশে ফিরে গেলে সব কমিটমেন্ট ভুলে যান। সমস্যা যে তিমিরের সে তিমিরেই থেকে যায়। দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনা পুঁজির সেক্টর প্রবাসী আয়। এই আয়ে রিজার্ভ পারে প্রবাসীরা হন দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন, রেমিট্যান্স যোদ্ধা। বহু অপ্রাপ্তির অবহেলার নিরব সাক্ষী হয়ে, নিজে নিঃশেষ হয়ে তবুও প্রবাসীরা অকাতরে দেশের জন্য তার সর্বস্ব তুলে দেন। এ যেন এক ডিলেম্যা, দেশকে ভাল না বেসে যে উপায় নেই তার সে ডিলেম্যা। এন্ড ডিলেম্যা হর্নস অব আ ডিলেম্যা।

 

 

পূর্বকোণ/বাপ্পি/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট