কেইস হিস্ট্রিঃ১> গত ৫ জুন আবুধাবির গ্রিন সিটি আলআইনে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধা লক্ষ্মীপুর নিবাসী মোহাম্মদ আরিফ হোসেন (৩০)। আবুধাবিতে বিমান অফিসে বারবার যোগযোগ করেও নিকটজনেরা তার লাশ পাঠানোর জন্য বিমানের বুকিং পাননি। ফলে লাশ পড়ে আছে তাওয়াম হাসপাতালের মর্গে। সেই লাশ ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে দুবাই হয়ে দেশে পাঠানো হবে ২০ জুন। দেশে পরিবার পরিজনদের মৃত্যুশোকে সবকিছু থমকে যাওয়া তারপর লাশের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা যে কত বেদনার তা সবাই বোঝে না। বিমান তো না-ই।
কেইস হিস্ট্রিঃ ২> গত ৯ জুন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে লেবার ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেন আবুধাবি প্রবাসী নির্মাণ শ্রমিক নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বসুরহাট চর পার্বতী গ্রামের মোহাম্মদ মানিক (৪৬)। দিনটি ছিল কর্মদিবস। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশের সুরতহাল তদন্ত করে তা বানিয়াসের সেন্ট্রাল মর্গে রাখে। বাংলাদেশ বিমান বা সরাসরি ফ্লাইটের অন্য কোন এয়ারলাইন্স না নেয়ায় তার লাশ বহু দেনদরবার করে গতকাল বুধবার রাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি থেকে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে করে নেয়া হয়েছে দোহায়। ট্রানজিট ফ্লাইটটি দোহায় দীর্ঘ যাত্রাবিরতির বিড়ম্বনা শেষ করে এরপর যাবে লাশ নিয়ে ঢাকায়।
কেইস হিস্ট্রি ঃ৩> চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামের আবুধাবি প্রবাসী শহীদুল আলম বাবুল (৫৫)। আবুধাবি শহরের উপকণ্ঠে সাহামায় বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে প্রবাসে নির্মাণ ব্যবসা করে আসছিলেন। গত ৪ জুন বুধবার তিনি কর্মস্থলে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। শিল্পনগরী মুসাফফাহর একটি গ্লাস ও মেটাল ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপক প্রশাসন এবং মৃতের আত্মীয় সৈয়দ মোরশেদ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, শহীদুলের মৃত্যুর পর থেকে তার লাশ বানিয়াসের মর্গে পড়ে আছে। দেশ থেকে আত্মীয় পরিজনদের ফোনের ওপর ফোন আসছে। আমরা লাশের জন্য তাদের অস্থির আহাজারি শুনছি কিন্তু আবুধাবি থেকে বিমান লাশ বহন না করায় আমরা অসহায়ভাবে তাদের কেবল সান্ত্বনাই দিয়ে যাচ্ছি। এমন হবে কেন? এখন অনন্যোপায় হয়ে আমাদেরকে লাশ দুবাই দিয়ে দেশে প্রেরণ করতে হচ্ছে। অথচ এই রেমিটেন্স সৈনিক শহীদুল তার কোম্পানিতে ৩৫-৪০ জন মানুষের কর্মসংস্থান করে দেশের রেমিটেন্স প্রবাহে অবদান রেখে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল দেশে ৩.২৭ বিলিয়ন ডলার যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২.২০ বিলিয়ন অর্থাৎ গেছে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৪৮%।
অথচ বাংলাদেশ বিমান ও অন্যান্য এয়ারলাইন্স আবুধাবি থেকে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের লাশ পরিবহনে অনীহা প্রকাশ করায় প্রবাসীদের দুর্ভোগ বাড়ছেই।
দূতাবাস কি বলছেনঃ এ বিষয়টি ওয়াকিবহাল আছেন কিনা আমরা জানতে চাই আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর হাজরা সাব্বির হোসেনের কাছে। তিনি জানান যে, তিনি বিষয়টি অবগত আছেন। তার দেয়া তথ্যমতে বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গড়ে পাঁচশ প্রবাসীর লাশ দেশে যায়। তার মধ্যে আবুধাবি থেকে যায় প্রায় অর্ধেক। আবুধাবি থেকে বিমানের ফ্লাইট ছোট হওয়ায় বিমান লাশ পরিবহন নিরুৎসাহিত করে। সে ক্ষেত্রে আমরা দুবাই দিয়ে প্রবাসীর লাশ বহন করতে পরামর্শ দিই।
বিমান কি বলছেঃ
বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিমানের আবুধাবি-আলআইন অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক আনোয়ারুল ফেরদৌস বলেন, আমরা আবুধাবি থেকে লাশ পরিবহন করছি না এমন না। কখনো সুপরিসর এয়ারক্রাফট হলে লাশ নিয়ে যাচ্ছি। নিয়মিতভাবে আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের জন্য সপ্তাহে যে সাতটি ফ্লাইট আছে তার সবগুলোই বোয়িং ৭৩৭। এগুলোর ধারণ ক্ষমতা ১৬২ হলেও সেইফটি রুল অনুযায়ী ১৩৬টি সিটের বেশি সিট বিক্রি করা যায় না। লাশ পরিবহন করলে আমাদেরকে ৩০-৩৫টা ব্যাগেজ অফ করে দিতে হয়। যাতে প্যাসেঞ্জাররা ক্ষুব্ধ হন। ডেডবডি সেনসেটিভ ইস্যু। আমরা ডেড বডিকে অনার করতে পারছি না। ছোট ফ্লাইটের কারণে এটি ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। তাই দুবাই দিয়ে আমরা লাশ পরিবহনকে এই মুহূর্তে উৎসাহিত করছি।
অথচ আবুধাবি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৮৭ ভাগঃ আমিরাতের মোট ভূভাগের ৮৭ শতাংশ জুড়েই আবুধাবি। জনবসতিও এখানে বেশি। বর্তমানে আমিরাতের ন্যাশনাল ক্যারিয়ার এতিহাদ এয়ারওয়েজ বাংলাদেশের সাথে ফ্লাইট অপারেট করছে না। বিমানের দেখাদেখি এয়ার অ্যারাবিয়াও লাশ নিচ্ছে না। বাংলাদেশের পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স বিমানের মত অন্যদের প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ বহনে দায়বদ্ধতা নেই। তাই দিনের পর দিন লাশ পড়ে থাকছে আবুধাবির হিমঘরে। বিষয়টি দুঃখজনক।
কি বলছেন আমাদের কম্যুনিটি নেতারাঃ
বিষয়টি নিয়ে আমরা আলাপ করেছি বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি আবুধাবির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন তালুকদারের সাথে। তিনি বলেন, সুপরিসর এয়ারক্র্যাফ্টের অভাবে বিমান প্রবাসী লাশ বহনে অনীহা প্রকাশ করছে। তাতে অনেক লাশ দিনের পর দিন পড়ে আছে। আমরা সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আবুধাবি সফরকালে এ বিষয়ে তাদের অবগত করেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি। যাতে আবুধাবি থেকে সুপরিসর ড্রিমলাইনার ফ্লাইট দেয়া হয়। দুবাই দিয়ে আবুধাবির লাশ পাঠাতে গেলে প্রবাসীদেরকে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তখন আবুধাবি পুলিশ ও দুবাই পুলিশের দুটি অনুমোদন লাগে। এতে প্রবাসী পরিবারের হয়রানি বাড়ে। আমরা এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি কারণ এতে আবুধাবি প্রবাসে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশ সমিতি ইউএই’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শওকত আকবর এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন যাবত আবুধাবি থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম বা সিলেটের কোন সুপরিসর ফ্লাইট নাই। এজন্য আবুধাবিতে মৃত্যুবরণকারী প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের লাশ দিনের পর দিন পড়ে থাকছে। বিষয়টি বেদনাদায়ক। আমরা মান্যবর রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ ব্যাপারে বিমান কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আবুধাবি প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মী আমির মোহাম্মদ বলেন, আবুধাবি থেকে বাংলাদেশের বিমানের ছোট ফ্লাইট হওয়ায় লাশ বহন করা হচ্ছে না। বিমান যেন বড় ফ্লাইট চালু করে কারণ প্রবাসীর লাশ যত বেশি বিদেশে পড়ে থাকবে তার পরিবার-পরিজনের কষ্ট তত বেশি বাড়বে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার এবং রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষ দেশটির তকমাধারী আমিরাতের প্রায় দশ লক্ষ প্রবাসীর মধ্যে নানা কারণে হৃদরোগ স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে ভুগে, আত্মহত্যার কারণে, সড়ক দুর্ঘটনায়, কর্মস্থলে সংঘটিত দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী প্রবাসীর মিছিল দিনে দিনে বাড়ছেই। এদের প্রতি সরকার যত বেশি সহানুভূতিশীল হবেন ততোই তাদের জীবন সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
পূর্বকোণ/পিআর