চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক হাসান মুহাম্মদ রোমান শুভকে অব্যাহতি দেওয়াসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২১ আগস্ট) দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসকল দাবি তুলে ধরা হয়।
এ সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য রাখেন বিভাগের ২৭তম শিক্ষার্থী নুর হোসেন বৈশাখ।
লিখিত বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ তুলে ধরেন। এগুলো হলো:
১. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মকাণ্ড ও ২৪ এর গণহত্যাকে সমর্থন দেওয়া এবং ফ্যাসিস্টদের দোসর হিসেবে কাজ করা।
২. ছাত্রদের নিজের বাসায় ডেকে মাদকের আসর বসানো এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছাত্রদের ব্যক্তিগত জীবন ও আইন বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষকদের নিয়ে অকথ্য ভাষায় কথা বলা, গালিগালাজ করা এমনকি অনেক ছাত্রকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করা।
৩. ছাত্রলীগকে মদদ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি দেয়া এবং রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা।
৪. ক্লাস পরিচালনাকালীন এবং নিজ অফিস কক্ষে ডেকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগ দেয়া (যেমন জামাত/শিবিরের এজেন্ট এবং অন্যান্য), বিভিন্নভাবে হয়রানি করা এবং ক্লাসের মধ্যে ছাত্রদের টার্গেট করে হেয় প্রতিপন্ন করা।
৫. প্রক্টর থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং ক্যাম্পাসের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে হয়রানি করা।
সংবাদ সম্মেলনে আইন বিভাগের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাইম ইসলাম বলেন, আমাদের শিক্ষক রোমান শুভ সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিজের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করতেন। বাজার করা, নিজের বাচ্চাদের দেখাশোনাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। বিভাগের কোনো অনিয়ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করা যেতো না।
আইন বিভাগের ২৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিয়াজ মাহমুদ বলেন, রোমান স্যার যখন সহকারী প্রক্টর ছিলন তখন আমাকে বেশ হয়রানি করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জারে ভুলে একটা রিয়েক্ট দেওয়াতে আমাকে কৈফিয়ত দিতে প্রক্টর অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। ৬ ঘণ্টা প্রক্টর অফিসে অপেক্ষা করার পরে স্যারের সাথে বিভাগে গিয়ে দেখা করতে বলা হয়। দেখা করলে আমাকে সেসময় বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা বলে শিবির ও জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া হয়। এ সময় আমার সঙ্গে আমার ব্যাচমেট ইফতিয়াজ তাহসিন এবং ওহিদ রশিদ ছিল।
এ সময় উপস্থিত আইন বিভাগের শিক্ষার্থী গাজী বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী অপপ্রচারসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ তুলে স্যার সবসময় পুলিশি হয়রানি করেছেন। আমার ওপর পুরো এক বছর ধরে তিনি এরকম পুলিশি হয়রানি চালিয়েছেন। তাছাড়া তিনি ক্লাসে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদেরকে হুমকি ও হয়রানি করতেন।
আইন বিভাগের ২৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসন রিয়াদ বলেন, আমরা রোমান শুভ স্যারকে না জানিয়ে সেন্টমার্টিনে বনভোজনে যাওয়ার কারণে তিনি আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পরে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলা হয়। এ নিয়ে ফয়সালা করতে তার বাসায় ডেকে পাঠান। তিনি ক্ষমা চাওয়ার নাম করে টানা এক ঘণ্টা তার পা ধরে বসিয়ে রাখেন।
নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ তুলে তাকে পুলিশে দেন আইন বিভাগের এই শিক্ষক। সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জুবায়ের হোসেন বলেন, আমি ২০২২ সালে রাসুলুল্লাহকে (সা.) নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদ করায় আমাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা করেন। পরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমরা শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টে আন্দোলন করলে আমাকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া যায় হয়। আমাকে তল্লাশি করা হয়। পরে মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে আমাকে পুলিশে দেওয়া হয়। তিন মাস আমি কারাগারে থাকি। পরে বেরিয়ে আসলে আমাকে আবারও একটা মিথ্যা অভিযোগ তুলে দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার আদেশ দেওয়া হয়।
বিভাগটির ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নুর হোসেন বৈশাখ বলেন, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তিনি সবসময় শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাতেন। তিনি ফলাফল আটকে দিবেন বলে সর্বদা হুমকি দিতেন। এই ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতো না।
তিনি আরও বলেন, রোমান শুভ স্যার মাদকের সঙ্গে সর্বদা জড়িত ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে মাদক আনাতেন। তিনি গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের উৎস বলে দিতেন। কোথায় মাদক আছে, তার কাছে আছে সেসব তিনি জানাতেন। শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মাদক আনতে বাধ্য করতেন। শিক্ষার্থীদেরকে নিজের বাসায় নিয়ে মাদকের আড্ডা বসাতেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো:
১. আইন বিভাগের শিক্ষক হাসান মুহাম্মদ রোমান শুভর দ্রুতসময়ের মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে হবে।
২. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাছে দাবি, ২৯ আগস্টের মধ্যে নিরপেক্ষ, শিক্ষার্থীবান্ধব ভিসি নিয়োগ দিতে হবে ও ভিসি কর্তৃক দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরপেক্ষ, শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসন নিয়োগ দিতে হবে। ভিসি নিয়োগের পূর্বে যদি হাসান মুহাম্মদ রোমান শুভ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন, তাহলে ভিসি নিয়োগের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে বহিষ্কার করতে হবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীসহ সকল ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে ও প্রশাসনিক ভবনে সকল ধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
৪. এলটমেন্ট দিয়ে আবাসিক হল খুলে দিতে হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক কার্যক্রম চালু করতে হবে। আটকে থাকা সকল রেজাল্ট প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. অনলাইনে সেন্ট্রাল ডাটাবেজের মাধ্যমে রেজাল্ট প্রকাশ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ব্যাপারে হাসান মুহাম্মদ রোমান শুভ বলেন, আমি মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছি। আমি কখনো গণহত্যাকে সমর্থন করি না, ২০১৬ সালেও আমি বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে গবেষণা করেছি এবং গবেষণা প্রবন্ধ ভারতের একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি তার প্রমাণ দিতে পারবো। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছি। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব, ইনশাআল্লাহ।
পূর্বকোণ/জুনায়েদ/জেইউ/পারভেজ