চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নে সশস্ত্র সংঘাত ও তথ্য বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবসমাজের ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (১১ জুন) দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজের (সিসিআরএসবিডি) উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বক্তারা এই অঞ্চলে কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) অস্থিতিশীলতার কারণে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি এই অস্থিতিশীলতার পেছনে আন্তর্জাতিক ইন্ধন, ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক কারণকে দায়ী করেন।
অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সিসিআরএসবিডি’র সদস্য তন্ময়ী হাসানের সঞ্চালনায় ধারণাপত্র তুলে ধরেন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. মাহফুজ পারভেজ। সভায় চবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. সেকান্দার চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক বেনু কুমার দে। এছাড়াও প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন মানিকছড়ি মং রাজবাড়ির রাজকুমার সুই চিং প্রু, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম ও চবি আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক।
ধারণাপত্রে সিসিআরএসবিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে। শান্তি একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে। পার্বত্য এলাকার পিছিয়ে পড়া তরুণ সমাজকে সুশিক্ষিত করতে হবে। ইতিহাস ও অধিকার সম্পর্কে তাদেরকে আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। অস্ত্রের মুখে কোনো সমস্যার সমাধান করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই আমাদের জ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অভিমতকে সরকারের নীতিনির্ধারনী পর্ষদে পৌঁছে দিতে হবে।
সিসিআরএসবিডির পরিচালক ও চবি আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল একটা শান্তি চুক্তি, তা সম্পন্ন করা হয়েছে। মানুষকে মূলধারার উন্নয়নের সঙ্গে একীভূত করতে সেখানে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি কেএনএফ নামক সশস্ত্র বাহিনী বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এই বহুমাত্রিক সংঘাত এই অঞ্চলের শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে। কিছু গ্রুপ বর্তমানে যুব সমাজ এবং ছাত্র সমাজকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সব ধরনের সুযোগ প্রদান করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটার মাধ্যমে তাদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়ন পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে নয় বরং সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তাই আমাদের তথ্য-বিভ্রান্তি থেকে সচেতন হয়ে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় চীন-লুসাই নামে একটি সেমিনারের কথা উল্লেখ করে সিসিআরএসবিডির পরিচালক ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম বলেন,পার্বত্য অঞ্চলকে তখন তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এতে অঞ্চলটি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার এই তিন অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। শাসন ভার পায় বার্মার কমিশনার। পরে নেতাজি সুভাষ বসু এই বৈচিত্র্যময় জাতীয়তাবাদকে এক করে ফেলেন। কিন্তু এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের একটা ধারণা বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে জো জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের ফলে এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ভূমি বিরোধ ও জাতিগত বৈষম্য এবং বিদ্বেষ এই এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় দাবি করে সেমিনারে মানিকছড়ি মং রাজবাড়ির রাজকুমার সুই চিং প্রু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির পরিবর্তে বিভিন্ন অশান্তি বিরাজমান। তাই প্রথমে অশান্তির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন সিয়েরা লিওন ও নেপালের গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুবসমাজের ভূমিকা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তি শুধু এদেশে নয় ভারত, মিয়ানমারেও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে দেশের সেবায় নিয়োজিত থেকে নিজেকে তথ্য বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
প্রধান অতিথি চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, শান্তিচুক্তির ফলে এই অঞ্চলের স্থিরতা ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। সরকার নৃগোষ্ঠীদের ভাষাকে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে। নৃগোষ্ঠীদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। সংবিধানের ২৮ ও ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা হয়েছে। তবে বর্তমান সমস্যাগুলোর পেছনে রয়েছে এই অঞ্চলের তথা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এবং এর সম্পদ। এই সমস্যাকে প্রথমে বুঝতে হবে। এর সমাধান খুঁজতে হবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত থেকে। আমরা দেখেছি সিয়েরা লিওন, রুয়ান্ডা এবং নেপালের গৃহযুদ্ধে তাদের যুব ও তরুণ সমাজ কিভাবে ভূমিকা রেখেছে। আমাদেরও তা করতে হবে।
পূর্বকোণ/জুনায়েদ/জেইউ/পারভেজ