চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : শিক্ষাবিদ কর্ত্তুলচন্দ্র বড়–য়া

সৈয়দ ইসমাইল হোসাইন

১৩ মে, ২০১৯ | ১:২৩ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষার আলো বঞ্চিত জনপদ রাউজান উপজেলার বিনাজুরি গ্রামে ১৩০০ সালের ১৩ কার্তিক (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ) আশালতা বড়–য়া ও বৈষ্ণবচরণ বড়–য়ার সংসার আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন কর্ত্তুলচন্দ্র বড়–য়া। কার্তিক মাসে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর মাতা-পিতা সোহাগ করে কর্ত্তুল নামকরণ করেন। তিনি মাতা-পিতার আদর যতেœ বিনাজুরি সোনাইরমুখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ শেষ করেন। এর পর আর্থিক দৈন্যে তাঁর শিক্ষাজীবন বন্ধ হয়ে যায়। পড়া-লেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ ও ধী-শক্তিসম্পন্ন হওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নোয়াপাড়ার প-িত সিন্দুরাজ বড়–য়ার বদান্যতায় তিনি রাউজান আর আর ইনস্টিটিউটে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯১৮ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন।
এরপর তিনি একাদশ শ্রেণিতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। পারিবারিক আর্থিক দীনতার জন্য তাঁকে লজিং থেকে ও প্রাইভেট টিউশনি করে ১৯২০ সালে আইএ এবং একই কলেজ থেকে ১৯২২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ¯œাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। বিনাজুরি, ইদিলপুর, লেলেংগারা, গুজরা, গড়দুয়ারা ও মোবারকখিল এলাকার প্রথম ¯œাতক তিনি। সেই সময়কার ইংরেজ সরকার তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করতে অনুরোধ করলেও সে লোভনীয় চাকরি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯২৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষকতা পেশাকে বরণ করে জাতিকে একটি শিক্ষিত ও মাধুর্যম-িত সমাজ উপহার দেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্রকে সুশিক্ষা দিয়ে জাতির সেবায় যুক্ত করেন। এই কারণে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনো তাঁর ছাত্রগণ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
দীর্ঘকাল শিক্ষকতার শেষপাদে আর্যমৈত্রেয় ইনস্টিটিউশন থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
এই শিক্ষাবিদ নিজ অঞ্চলের সকল শ্রেণিপেশা লোকের নিকট অতিপ্রিয়জন হিসেবে শ্রদ্ধারপাত্র ছিলেন। সে কারণে এলাকাবাসী তাঁকে ১৯৩৫ সালে বিনাজুরি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে তিনি অকুণ্ঠচিত্তে জনগণের সেবায় সর্বোতভোবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদ অহোরাত্রি পরিশ্রম করে, শিক্ষকতার পাশাপাশি দৈনিক কয়েকটি টিউশনি করে সৎপথে অর্থ উপার্জন করেন এবং পর্যায়ক্রমে বাড়িঘর তৈরি, পুকুর খনন ও ভূ-সম্পদের মালিক হয়ে অর্থ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভ করেন।
মাস্টার কর্ত্তুলচন্দ্র বড়–য়া নিজস্ব সম্পত্তির উপর জনহিতকর বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এলাকায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পশ্চিম বিনাজুরি উচ্চ বিদ্যালয়, কর্ত্তুল-স্বর্ণলতা কমিউনিটি ক্লিনিক, ধর্মকথিত অনাথ আশ্রম, বিনাজুরি শ্মশান বিহার, বিনাজুরি তুরপণ সংঘ এবং বহু অসহায় পরিবারকে বাসস্থান তৈরি করে দিয়ে মানবতার সেবায় অবদান রাখেন। এতদ্ব্যতীত তিনি চট্টগ্রাম জর্জকোর্টের আমৃত্যু জুড়ি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মহাবোধি পালিটোলের অধ্যক্ষ ও বিনাজুরি শ্মশান বিহারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি চার পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক। সবাই শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
এই আলোকিত পুরুষের জ্যেষ্ঠসন্তান সুকুমার বড়–য়া বর্তমানে রাউজান উপজেলার বিনাজুরি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এলাকার সার্বিক উন্নয়নে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গঠনে অবদান রেখে চলেছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাস্টার কর্ত্তুলচন্দ্র বড়–য়া জীবনসায়াহ্নে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৩৭৯ সালের ৭ পৌষ (১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) শুক্রবার ৮০ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে পরলোক গমন করেন।

লেখক : গবেষক সৈয়দ ইসমাইল হোসাইন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট