
মানুষের উৎপত্তির পুর্বে প্রাণীজগতের বিবর্তন ঘটেছে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে তারা পরিবর্তন করছে নিজেদের প্রয়োজন বা চাহিদা অনুসারে কাজকর্মের মাধ্যমের। ভাষা অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। ভাষার প্রধান কাজ হলো পরস্পরের ভাব বিনিময় করা। এই ভাব বিনিময় প্রথমে কণ্ঠের শব্দের মাধ্যমে হতো না, হতো শরীরের অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে। যেভাবে আমাদের সমাজে বোবারা ভাব বিনিময় করে। কণ্ঠস্বরের সাহায্যে ভাষার বিকাশের অন্যতম দক্ষতা হলো, আমাদের শ্রবণ শক্তির বিকাশ। বোবারা শুনতে পায় না বলে তারা ভাষা শিখতে পারে না। তাই ভাষার দক্ষতা অর্জনের জন্য শ্রবণযন্ত্র ও কন্ঠস্বরের বিকাশ অপরিহার্য ছিল। তেমনি সমান্তরালে মানুষের মগজের বিকাশ হতে হয়েছে সমন্বয়ের জন্য। হাতের দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে দাঁতের ব্যবহার কমে যায়। ফলে, চোয়াল ছোট হয়ে যায়। মস্তিষ্কের খুলিতে মগজের পরিমান বৃদ্ধির জন্য জায়গা তৈরী হয়ে যায়। মুখের গড়নের আদল বদলে যায়। কন্ঠস্বরের সাহায্যে ভাব আদান-প্রদান বিকাশের সাথে সাথে অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে ভাব আদান-প্রদান গৌণ হয়ে হয়ে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিকযুগে আত্মরক্ষার জন্য এবং শিকারের জন্য মানুষ পাথরের সাহায্য নিত, পাথরের তৈরী বিভিন্ন হাতিয়ার বানাত, এই হাতিয়ার বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতো। তাই তখনকার সমাজের নামকরণ করা হয়ে ছিল পাথরের যুগ। পাথরের যুগকে পুরাতন পাথরের যুগ এবং নতুন পাথরের যুগ হিসেবে ভাগ করা হয়।
পুরাতন পাথরের যুগের সংস্কৃতিঃ খাদ্য সংগ্রহ করতে হতো। ফলমূল সংগ্রহ করা এবং জীবজন্তু শিকার করাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটাকে শিকারী সমাজও বলা যেতে পারে। খাদ্যের জন্য মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভর করতো। পুরাতন পাথরের যুগে শীত থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া পরিধানের মাধ্যমে বস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। আগুনের ব্যবহার শিখে হিং¯্রপশু ও শীত থেকে আত্মরক্ষা এবং রান্না করা শিখে। খাদ্য হিসেবে মাছের ব্যবহার আগুন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তখন বাইরে ঘুরতো খোলা মাঠে শুতো, ঘুমাত এবং দুর্যোগ বা শীতে বৃক্ষে বা গুহায় আশ্রয় নিতো। কিন্তু প্রথমে আগুন উৎপাদন করতে পারতো না। বজ্রপাত বা অন্যকোন কারণে আগুন ধরে গেলে বনের আগুন সংরক্ষণ করতে হতো। পরে পাথরের সাথে পাথর ঘষে আগুন জ¦ালাতে শিখে। তীর ধনুকের সাহায্যে পশু শিকারেও দক্ষ হয়ে উঠে। এভাবে যৌথজীবন ও জিনিষপত্র বানাতে গিয়ে ভাব বিনিময়ের জন্য এই সময় পৃথকোচ্চারিত ভাষার উৎপত্তি হয়। শীতের সময় গুহায় অলস সময়ে জীবজন্তুর ছবি আঁকতে গিয়ে চিত্র কলার উদ্ভব হয়। মৃতদের কবর দিত। সাথে অস্ত্র্র ও খাদ্য দিয়ে দিত।
তখনকার সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক। কারণ সন্তান জন্মদান এবং সন্তানদের লালনপালন করার জন্য একটি স্থায়ী আবাস প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। পুরুষেরা খ্যদ্য সংগ্রহের জন্য বাইরে গেলে তখন এই স্থায়ী আবাসের দায়িত্বে থাকতো মায়েরা। খ্যদ্য যোগাড় করে আনার পর তা স্থায়ী আবাসের কর্তৃত্বে মায়েদের হাতেই জমা হতো। ফলে মায়েদের কর্তৃত্ব ছিল অবিসংবাদিত। তাই এই সমাজকে বলা হতো মাতৃতান্ত্রিক। যেহেতু এক পতি একপত্নী পরিবারের উৎপত্তি হয় নি, সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ কঠিন ছিল। তাই মায়ের কর্তৃত্বই ছিল সমাজের নিয়ম। স্থায়ী আবাসের আশে পাশে ফেলে দেয়া বীজ থেকে বৃক্ষের জন্ম থেকেই কৃষি কাজের ধারণা আবি®ৃ‹ত হয়। যার কৃতিত্ব নারীকে দেয়া হয়।
নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতি ঃ কৃষি আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন পাথরের যুগের উৎপত্তি হয়। খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পায়। কৃষি আবিষ্কারের ফলে পশুপালনের ধারণা বিকশিত হয়। পাথরের কুঠার, হাড়, শৃঙ্গের তৈরী জিনিষ, নিরাপত্তার জন্য কুকুর পালন এবং মৃৎশিল্পের আবিষ্কার হয়। লিখন পদ্ধতিও এই সময় শিখে ফেলেছিল। বয়ন শিল্পে ও গৃহনির্মাণেও দক্ষ হয়ে উঠে। খাদ্যের সংকট কমে যাওয়ায়, উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহের প্রবণতা এবং এর মালিকানাকে কেন্দ্র করে বিকাশ ঘটে ব্যক্তি মালিকানার। ব্যক্তিমালিকানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পুরুষশাসিত সমাজ ও উত্তারাধিকার পদ্ধতি। সেই সাথে প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন আবিষ্কারের হয়। গোত্র থেকে বাড়তে বাড়তে উপজাতি। সেখানে জাতিতে রূপান্তর ঘটে। গ্রাম-সভ্যতা বিকশিত হয় এই সময়ে। এর পর আসে নগর সভ্যতা। নগর সভ্যতার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক। জাতি হিসেবে গড়ে উঠার জন্য তার কেন্দ্র বা নেতৃত্ব দরকার। তখনই নগরের বিকাশ ঘটে। নগর সভ্যতার মাধ্যমে একটি জাতির প্রাথমিক শর্ত পূরণ হয়। বাংলা অঞ্চলে অস্ট্রিকদের প্রবর্তিত গ্রাম-সভ্যতার প্রাধান্য বেশী। অস্ট্রিকরা কোনো নগর বা গড়ে তুলেছিল কিনা তার কোন চিহ্ন বা প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে শান্তিনিকেতনের নিকটে পা-ুরাজার যে প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কার হয় সেখানে পাথর যুগের নিদর্শন যেমন পাওয়া গিয়েছে তেমনি তা¤্র যুগেরও পাওয়া গিয়েছে । তাই এটা কখনকার তাই নিয়ে বিতর্ক আছে।
ভারতে মানব প্রজাতির উত্থানের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ২ থেকে ৪ লক্ষ বছর পূর্বেও মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তবে, পুরাতন পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে। বাংলা অঞ্চলে নতুন পাথরের যুগের কৃষি সমাজের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এর পর সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। যা নগর সভ্যতার উত্থান বলা যেতে পারে। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নগরসভ্যতা যা প-িতেরা অনুমান করেন দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীর অবদান, যা আর্যদের আসার পূর্বে। তবে বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠী আসার পূর্বে যে নৃগোষ্ঠী এসেছিল এবং বাংলাদেশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা হচ্ছে আস্ট্রিক বা প্রটো-অষ্ট্রোলাইড। পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমুদ্রে গর্ভে থাকলেও চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চল ছিল ব্যতিক্রম। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছাগলনাইয়া থানায় একটি হস্ত কুঠার পাওয়া গিয়েছে পাথরের যুগের। রাঙামাটিতে কুঠার পাওয়া গিয়েছে পাথরের যুগের। সীতাকু-ের কাঠের তরবারী নতুন পাথরের যুগের। কুমিল্লা লালমাই অঞ্চলের শালবন ও আনন্দ বিহারে নতুন পাথরের যুগের অনেক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান বাসিন্দারা আরো অনেক পরে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তারা বার্মা বা পূর্ব দিক থেকে আগমন করে। তার পূর্বের কোনো জনগোষ্ঠীর কোনো অবস্থান বর্তমানে নাই। তবে, সীতাকু- এবং রাঙামাটিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের কুঠার পাওয়া গেলেও কোন অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী বা অন্য কোন আদি জনগোষ্ঠীর কোন অস্তিত্ব এখনও জানা সম্ভব হয় নি। তবে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের ভূমিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে জনবসতি ছিলো, মানুষ বাস করতো। এই সকল অঞ্চলে ধান চাষ এবং ভাত খাওয়ার অভ্যেস প্রমাণ করে এই অস্ট্রিকরাই বাঙালিদের পূর্ব পুরুষ। পশুর মাংসের তুলনায় মৎস্যপ্রীতিও এই অস্ট্রিকদের অবদান। সেই সাথে কলা, বেগুন, লাউ, লেবু, পান (বর), নারকেল জামুরা, কামরাঙ্গা ডুমুর, হলুদ, সুপারী, ডালিম প্রভৃতি তখন চাষ করতো। দ্রাবিড়রা গম এবং যবের প্রচলন করে। সেখানে খাদ্যাভ্যাস হিসেবে রুটির প্রচলন হয়। তবে, বাংলাদেশে অস্ট্রিক সংস্কৃতির কারণে ভাত সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। এই অঞ্চল বৃষ্টি প্রবণতার কারণে ধান উৎপাদন অনেক সহজ। গম এবং যব শুকনো আবহাওয়ার ফসল।
অষ্ট্রিকরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করলেও সমাজ পিতৃতান্ত্রিক না মাতৃতান্ত্রিক তা সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায় না। তবে, বাংলাদেশের দ্রাবিড় ভাষার রচনারীতি এবং শব্দ বাংলাভাষায় প্রবেশ করেছে যত না দ্রাবিড় থেকে সরাসরি, তার চেয়ে আর্য ভাষার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আত্মস্থ হয়েছে বলে প-িতেরা মনে করেন। অস্ট্রিকদের খাদ্যাভ্যাস ভাতের সাথে শাক না মাছ এ নিয়ে যতই প্রশ্ন উঠুক দক্ষিণ ভারতে নিরামিষের প্রাধান্য এবং উত্তর ভারতে মাংসের প্রাধান্য থাকলেও প্রগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালির ভাতের সাথে মাছ-শাক ছিল প্রধান খাদ্য। মাংসেও তাঁর অরুচি নেই। অর্থাৎ এদিক থেকে সে এগিয়ে। কিন্তু মাছ খেত বলে এই বাঙালিদের অবজ্ঞা করতো আর্যরা। ভাতের সাথে সহজলভ্য শাক ও মাছ ছিল বাংলা অঞ্চলের খাদ্যের বৈশিষ্ট্য । মাছ রান্নার বৈচিত্র্য বাংলায় বেশী। যেখানে মাছ সহজলভ্য নয় সেখানে সহজলভ্য অঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত মাছ সরবরাহ করার জন্য শুকনো মাছ বা শুটকির প্রচলন হতে পারে। আবার, দ্রাবিড় গোষ্ঠী যব ও গমে অভ্যস্ত থাকলে রুটির সাথে মাংসের যত সখ্য, মাছের সাথে তুলনামূলক কম। সে দিক থেকে বিবেচেনা করলে অস্ট্রিকদের কাছ থেকে দ্রাবিড়রা মাছ খাওয়া শিখতে পারে।
বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রধান পরিচয় বাংলা ভাষায় কথা বলাতে। তার সাথে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর নৃতাত্বিক প্রাধান্য যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের ভাষার প্রভাব। যদিও দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠী বা আর্যদের প্রভাবে বাচনরীতি এবং ব্যাকরণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবু বাংলা ভাষায় অস্ট্রিকদের শব্দের ভা-ার কম নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই অঞ্চলে কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর অস্ট্রিকদের প্রবর্তিত খ্যদ্য অভ্যাস থেকে এখন পর্যন্ত বাঙালি মুক্ত হতে পারে নি। বাঙালির অতীত খুঁজে বের করতে অন্যতম উপকরণ হচ্ছে প্রাচীন ও বর্তমান বাস্তব সভ্যতা এবং মানসিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ। সেই সাথে ভাষার বিশ্লেষণ। অস্ট্রিক কি ভাষা গোষ্ঠী, না নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ, এই সকল অঞ্চলে এত বেশী জনপ্রবাহ এসেছে, ভাষা ও সংস্কৃতি এবং দৈহিক বৈশিষ্ট্য দুটোই দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। তবু তার মূল বৈশিষ্ট্য অবলুপ্ত হয় নি।
বাংলাদেশের কোথাও প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন নরকঙ্কাল এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের জনতত্ত্ব সম্পর্কে এখনও সুষ্পষ্টভাবে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবু যুক্তি ও অনুমানের ভিত্তিতে সাময়িক সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে। মানবজাতির ইতিহাসে প্রাগৈতিহাসিক যুগে সমাজ বিকাশের যে বৈশিষ্ট্য ছিল – প্রথমে গোত্র, সেখান থেকে উপজাতি এবং উপজাতি থেকে জাতি গড়ে উঠার যে সনাতন ধারা তা বাংলা অঞ্চলে এখনও সুনির্দিষ্ট করা যায় নি। ভারতবর্ষে বিবর্তনের মাধ্যমে মানবগোষ্ঠীর উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয় নি। ধারণা করা হচ্ছে, নিগ্রোবই এবং অষ্ট্রিকরাও বাইরে থেকে এসেছে। তবে, নিগ্রোবটুদের উত্তরাধিকার আন্দামানের আদিবাসীদের এবং মু-াদের ধরা হলেও বাংলা অঞ্চলে তাঁদের সংখ্যা কম। বাংলাদেশে অস্ট্রিকদের ভাষা ও সংস্কৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বাঙালির মধ্যে প্রধান প্রবাহমান ধারা। সেখানে দ্রাবিড়দের প্রভাব সামান্য থাকলেও নিগ্রোবটুদের প্রভাব নাই বললেই চলে। পরবর্তীতে আর্য, মঙ্গোলীয় সহ আরো অনেক গোষ্ঠীর প্রভাবে বাঙালি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে মূলধারা হিসেবে অষ্ট্রিকদের ধারা বাঙালি এখনও বহন করে চলছে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।