কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ। ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। পটিয়াস্থ চেম্বার। ‘নিয়মিত ওষুধ খাবেন, হাঁটবেন, ভালো থাকবেন’ – আমার কথায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ব্যাংক কর্মকর্তা যুবকের চেহারায় আশ^স্থ হবার ভাব ফুটে উঠলো। ব্যবস্থাপত্রসহ যখন তিনি বিদায় নিচ্ছিলেন ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। জানালার পাশর্^স্থ আমবাগানে অপরাহ্নের হলদেটে আভা মিলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার ধূষর ছায়া নেমেছে এর মধ্যেই। প্রকৃতি যেন কি হারানোর বেদনায় বিরহকাতর হয়ে পড়েছে। আম গাছের পাতাগুচ্ছের ভেতর জমে থাকা অন্ধকার আরো গাঢ় দেখাচ্ছে। এর ভেতর থেকে নাম না জানা ছোট ছোট পাখী হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে কিচির মিচির কলতানে ডালে বসে পাখা নাড়ছে। পরক্ষণেই পাখা মেলে দিচ্ছে আকাশে। মেঘহীন নীল আকাশ হেমন্তের আগমনী বার্তা বয়ে এনেছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে চেম্বারে নিবন্ধ করতেই ক্ষণিক পূর্বের যুবকের চেহারাটা মানসপটে ভেসে উঠলো।
গতকাল দুপুরে যুবক চেম্বারে এসেছিলেন তাঁর কলেজ পড়–য়া ছোট ভাই-এর কাঁধে ভর দিয়ে। অভিযোগ ছিলো দ্রুত শ^াস প্রশ^াস, বুক ধরফর করা ও চরম ক্লান্তি। পরীক্ষা নিরীক্ষায় তাঁর অভিযোগের সত্যতা মিললো। আপাতঃ রোগ নির্ণয় : সাইনাস টেকিকার্ডিয়া। রোগের ইতিহাসে যা পাওয়া গিয়েছিলো তার সারমর্ম হচ্ছে : দ্রুতলয়ে হৃদস্পন্দন ও দ্রুতশ^াস প্রশ^াসে আক্রান্ত যুবকটি কম্যুনিটি সেবাকর্মীর পরামর্শে ব্রংকিয়াল এজমা-এর ওষুধ সেবন করেছিলো। কিন্তু রোগী ব্রংকিয়াল এজমাতে আক্রান্ত ছিলো না বিধায় তাঁকে প্রদত্ত ওষুধটি সঠিক ছিলো না। ভুল ওষুধের কারণে রোগীর হৃদস্পন্দন আরো দ্রুতলয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো এবং তাঁর শ^াস প্রশ^াস আরো দ্রুততর হয়ে পড়ছিলো যার কারণে রোগী তীব্র ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে। যথারীতি রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দেয়ার পর রোগী সুস্থ রোধ করায় আজ বিকালে পর্যবেক্ষণের জন্য পুনরায় এসেছিলেন। বর্তমানে রোগীর হৃদস্পন্দন সঠিক মাত্রায় নেমে এসেছে এবং শ^াসকষ্ট আর নেই। এখানে যে ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলছিলো সেটি হচ্ছে কম্যুনিটি ক্লিনিক-এ এম বি বি এস চিকিৎসকের পদ না থাকা এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাবিহীন সেবাকর্মী দ্বারা ভুল পরামর্শে রোগীর মৃত্যু হবার আশংকা থাকা। এ সমস্যায় সরকারের জরুরীভাবে করণীয় এবং সরকারী খাতে খুবই অপর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ দান সম্পর্কে আজকে আলোচনা করার আশা রাখি।
স্বাস্থ্যখাতে কতজন চিকিৎসকের পদ থাকা উচিৎ
ক) প্রাইমারী স্বাস্থ্যখাত : ১) ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র : ৪৫৫৪টি। রোগীদের প্রতিদিন উপস্থিতি ৫০ থেকে ১০০জন। গড়ে ৮০ জন। সারাদেশে মোট সংখ্যা ৩৬৩৩২০ জন। ত্রিশ জন রোগীর জন্য একজন এমবিবিএস হিসেবে মোট চিকিৎসক প্রয়োজন ১২১১০জন। ২) কম্যুনিটি ক্লিনিক : ১৩৮৬১ টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ১০০-২০০ জন। গড়ে ১৫০ জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ২০৭৯১৫০জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৬৯৩০৫জন। ৩) উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র : ৪৯২টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ৫০০-১০০০জন। গড়ে ৭৫০ জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ৩৬৯০০০জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ১২৩০০ জন। ৪) প্রাইমারী স্বাস্থ্যখাতে মোট চিকিৎসক প্রয়োজন : ১২১০০+৬৯৩০৫+১২৩০০ = ৯৩৭১৫জন।
খ) সেকে-ারী স্বাস্থ্যখাত : জেলাসদর হাসপাতাল। প্রতিজেলায় ১টি হিসেবে ৬৯টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ১০০০-২০০০জন। গড়ে ১৫০০জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ১০৩৫০০জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৩৪৫০ জন। গ) টারশিয়ারী স্বাস্থ্যখাত : মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সরকারী মোট ৩৬টি। রোগীদের প্রতিদিনের উপস্থিতি ৩০০০-৬০০০জন। গড়ে ৪৫০০ জন। সারাদেশে মোট রোগীর সংখ্যা ১৬২৫০০জন। এমবিবিএস চিকিৎসক প্রয়োজন ৫৪০০জন। ঘ) স্বাস্থ্যখাতে মোট চিকিৎসক প্রয়োজন : প্রাইমারী খাত + সেকে-ারী + টারশিয়ারী= ৯৩৭১৫ +৩৪৫০ + ৫৪০০ = ১০২৫৬৫ জন।
বর্তমানে সরকারী চিকিৎসকের সংখ্যা :
বর্তমানে সরকারী চিকিৎসকের সংখ্যা ২৬১৫৩ জন। যা মোট প্রয়োজনের ২৫.৪ শতাংশ মাত্র। সরকারী চিকিৎসক আরো কত প্রয়োজন : সরকারী চিকিৎসক আরো প্রয়োজন (১০২৫৬৫-২৬১৫৩) বা ৭৬৪১২জন। দেশে সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে কতজন এমবিবিএস চিকিৎসক আছেন : বিএমডিসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৯৩৭৬৩। তাদের মধ্যে এমবিবিএস ৮৫৬৩৩ এবং বিডিএস ৮১৩০।
প্রতি বৎসর কতজন চিকিৎসক পাশ করে বেরুচ্ছে :
দেশে বর্তমানে মোট মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ১০৬টি। তারমধ্যে সরকারী ৩১টি, বেসরকারী ৬৯টি, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ৬টি। এর বাইরে সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে ডেন্টাল কলেজ ১৫টি এবং ডেন্টাল ইউনিয়ন ২১টি রয়েছে। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে প্রতি বছর ১০০০০ ডাক্তার পাশ করে বেরুচ্ছে।
চিকিৎসক সংকট সমাধানে সরকারের করণীয় :
১) জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্য জনশক্তি নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া ২) স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে জিডিপি-এর ৫ শতাংশ বা মোট বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করা ৩) ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কম্যুনিটি ক্লিনিক সমূহের সমস্যাদির সমাধান ও যথাযথ পুনর্গঠন করা : ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র : ক) পর্যাপ্ত ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা : স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশের লোকসংখ্যা যখন ৪ কোটি ছিলো তখনকার হিসেব অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে ১টি করে কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিলো। বর্তমানে যেহেতু লোকসংখ্যা প্রায় ৪ গুণেরও বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে অতএব সে অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৪টি কেন্দ্র স্থাপন করা খ) উক্ত কেন্দ্র সমূহে মহিলা ও পুরুষ এমবিবিএস চিকিৎসককে চিকিৎসা করতে দেয়া গ) উক্ত চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চৌহদ্দীতে করা ঘ) উপজেলা থেকে ইউনিয়নে আসা-যাওয়ার জন্যে সার্বক্ষণিক সরকারী নিরাপত্তাকর্মী ও বাহন-এর ব্যবস্থা করা ঙ) সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, মাতৃমঙ্গল সম্পর্কিত বিবিধ কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স : ক) এগুলোতেই বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকদের পোস্টিং দেয়া খ) চিকিৎসক সংকট নিরসন করা গ) চিকিৎসা সহকারী সংকট নিরসন করা ঘ) চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্র নিশ্চিত করা ঙ) হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সারানো চ) চিকিৎসকদের আবাসন নিশ্চিত করা ছ) উপজেলার সাথে ইউনিয়ন সমূহের মধ্যে গাড়ী চলাচল উপযোগী রাস্তা রাখা জ) সার্বক্ষণিক এম্বুল্যান্স এর ব্যবস্থা রাখা ঝ) চিকিৎসকদের চাকুরীগত মর্যাদা আপগ্রেড করে সম্মানজনক অবস্থানে নেয়ার জন্য প্রশাসনিক পুনর্গঠন করা এবং কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসককে ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা প্রদান করা। কম্যুনিটি ক্লিনিক : এ প্রকল্পে সেবা দিচ্ছে এইচএসসি সম্মান আর্টস, কমার্স, কারিগরী, মানবিক ইত্যাদি যেকোন বিভাগের ছাত্ররা। তাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার’ যাদের মাত্র ৩ মাসের একটি প্রশিক্ষণ দিয়ে এখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এতো স্বল্প মেয়াদী ট্রেনিং দ্বারা প্রাইমারী চিকিৎসা প্রদানের যথাযথ জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় না বিধায় উক্ত সেবাকর্মীদের ওষুধ নির্বাচনে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ও চিহ্নসমূহ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকায় শুধুমাত্র রোগীর অভিযোগ শুনে সেবাকর্মীরা বুঝতে পারে না যে উক্ত রোগীর চিকিৎসা দেয়া তাদের আওতাভুক্ত কিনা। তাছাড়া রোগীকে এমবিবিএস চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বলা হলেও রোগীর তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা মেটাতে তারা অনেক সময় ওষুধ না দিয়ে পারে না। দেখা যাচ্ছে যে, উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুলভ্রান্তি হবার সম্ভাবনা থাকছে এবং সেটা রোগীর মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে। অতএব, জরুরী ভিত্তিতে এ প্রকল্পটি এমবিবিএস চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা উচিৎ। অন্যথায় অতি নি¤œমানের স্বাস্থ্য সেবার প্রতি জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে এবং অতি দ্রুত প্রকল্পটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশংকা থাকছে।
৪) সরকারী নিয়োগের মাধ্যমে প্রাইমারী, সেকে-ারী ও টারশিয়ারী স্বাস্থ্যখাতে কমপক্ষে ১০২৫৬৫ চিকিৎসকের পদ পূরণ করা ৫)শূন্য পদসমূহ পূরণ করা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী প্রতি বৎসর গড়ে ৩ শতাংশ চিকিৎসক অর্থাৎ ৩০৫৫জন চিকিৎসক কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ অবসরে, কেউ স্বেচ্ছায়, আবার কেউ মৃত্যুবরণ করার ফলে পদখালি করছেন।
৬) বৃদ্ধি প্রাপ্ত জনসংখ্যার জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করে সেগুলো পূরণ করা : বিশ^ব্যাংকের হিসেব মতে বাংলাদেশে প্রতি বৎসর ১.০১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি প্রাপ্ত জনসংখ্যার জন্য সরকারকে নতুন করে পদ সৃষ্টি করে তাতে নিয়োগ দিতে হবে ১০২৮ জন চিকিৎসক।
উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে উপসংহারে বলতে চাই যে, স্বাস্থ্যখাতের প্রতিটি স্তরে চিকিৎসকের মেধার অপচয় যেন না হয় এবং রোগীরা যেন সুচিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয় এমনি লক্ষ্য সামনে রেখে রোগী বান্ধব চিকিৎসামুখী পরিবেশ তৈরী করতে হবে এবং সে সাথে চিকিৎসকদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
ডা. হাসান শহীদুল আলম চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।