চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভারত ভ্রমণ: শিকড়ের খোঁজে

 নাওজিশ মাহমুদ

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

গ্যাংটক পাহাড়ি শহর। পাহাড়গুলি অধিকাংশ খাড়া। রাস্তাসমূহ অনেক বিপজ্জনক মনে হলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড একটি বিল্ডিং-এর নীচতলায়। এখানে পাহাড় না কেটে অক্ষত রেখে বিল্ডিংসমূহকে নির্মাণ করা হয়েছে। একটি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে নাম বললাম চিনতে পারলো না।

 

অবশেষে হোটেল তারা প্যালেসের নাম বলার পর ওখানে নিয়ে গেল। ট্যাক্সি হোটেল তারা প্যালেস পার হয়ে একটু সামনে থামলো। রাস্তা খুব খাড়া। নীচের দিকেই তারা হোটেল প্যালেসের বিপরীতে একটি ছোট সাইনবোর্ড হোটেল নামগিয়াল হাউজ। আমাকে ট্যাক্সি ড্রাইভার বললো, তার গাড়ি ব্যাক করা সম্ভব হবে না। আমাকে এই টুকু রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। তাই ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছোট্ট সাইনবোর্ড দেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হোটেলের দেখা পেলাম। ম্যানেজারের নাম প্রবীর দাস। বাঙালি। কথায় মনে হলো চুক্তিতে হোটেল চালাচ্ছে। ম্যানেজার প্রবীর দাস মৃদুভাষী এবং সহযোগিতা পরায়ন। তার দ্জুন স্টাফ। তারাও দেখলাম খুব সহযোগিতা করছে। কার আগে কে সার্ভিস দিবে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে ।

 

সার্ভিসম্যান একজন বাঙালি আরেকজন বিহারি। হোটেল লবি তিন তলায় মনে হলো। আর থাকার রুম সেখান থেকে আরো উপরে তিন তলায়। লবিতে খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলও দেখলাম। হোটেলে ফরম পূরণ করে রুমে গিয়ে মন ভরে গেল। ভিতরে ছিমছাম। খাওয়ার টেবিলসহ আছে। ল্যাপটপে বসে কাজও করা যাবে। বাথরুম একেবারে আধুনিক। তবে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার উপায় নেই। কারণ জানালার সাইডে পাহাড় পড়েছে। বেলকুনিও নাই। পাহাড় এবং রাস্তার মাঝখানে হোটেলে। তবে শীত লাগছে একটু। রুমে ফ্যান নাই। গ্যাংটকে সারা বছর আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে। শীতকালে কোন কোন অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়। অনীল যাদব আসলো আমার সাথে দেখা করে গেল। কতক্ষণ গল্প করলাম। দুপুরে পথে খেয়ে আসাতে এখানে আর কিছু না খেয়ে একটু শুয়ে বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করলাম। ঠান্ডা লাগছে। তাই লেপ মুড়ে দিয়ে শুয়ে থাকলাম। যদি ঘুম আসে ভালো। না আসলে বিকেলে গ্য্যংটক শহর ঘুরে আসবো।

 

একটু ঘুমিয়ে বের হলাম। গান্ধী মার্গে যাবো প্রবীর পথ বাতলে দিলে। প্রায় এক কিলোমিটার উপর দিকে উঠতে হবে পাহড়ের চুড়ায়। ধীরে ধীরে উঠলাম। একটু আগে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি থামাতে পাহাড় বেয়ে উঠতে কোন অসুবিধা হয়নি। গান্ধী মার্গের প্রবেশপথে ভারতরাষ্ট্রের জনক গান্ধীর বিরাট ভাষ্কর্য আমাকে স্বাগত জানালো। বেশ প্রশস্ত রাস্তা। একপাশে গাড়ি চলাচলের জন্য আরেক পাশে হাঁটার জন্য। দুইপাশে সারি সারি দোকান। তবে গাড়ির চলাচলের চেয়ে হাঁটার রাস্তা অনেক প্রশস্ত। একেবারে বিদেশি রাস্তার পরিবেশ। এই খানে অনেকগুলি হোটেলে। থাকা এবং খাওয়ার। হাঁটার রাস্তা ও গাড়ি চলাচলের মাঝখানে বসার জন্য কালো টাইলসের বসার জায়গা। অনেকে এখানে বসে গল্প গুজব করে। আমার কাছে মনে হলো পার্কের মতো। কিছু গাছও শোভা পাচ্ছে। হাঁটার রাস্তা কালো পাথর দিয়ে গাঁথনি করা। আমার কাছে অপূর্ব মনে হচ্ছিল।

 

ভারতে প্রথম ইউরোপীয় স্টাইলের শহর দেখলাম। অনিল বাবুর এখানে একটি দোকান আছে। ডিপার্টমেন্ট স্টোর স্টাইলে। দক্ষিণ কোরিয়ার মালামাল বিক্রয় করেন। ভীড়ও দেখলাম। নিজেদের একটি শেয়ারে রিসোর্টও আছে। আমি অনিল বাবুসহ বসে কতক্ষণ সময় কাটালাম। অনিল বাবু কলকাতা থেকে লেখাপড়া করেছেন। প্রেম করে একটি নেপালি মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার করছেন। শশুরবাড়ি সিকিম। শিলিগুড়ি থেকে আসতে পথের ধারে পড়ে। পাহাড়ের উপর ঘর। আমি যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। অনিল বাবু সানন্দে সম্মতি দিলেন। পরের দিন সাঙ্গু লেকে যাবো। তিব্বত বর্ডারের পাশে। অনিল বাবু গাড়ী ঠিক করে দিলেন। পাশপোর্টের ফটোকপি ও একটি ছবি দিতে হলো। যাওয়ার পূর্বে অনুমতি নিতে হবে। ড্রাইভার এই অনুমতিসহ যাবতীয় কাজ সেরে আমাকে নিতে হোটেল আসবে। সাথে গাইডও। গাইড ছাড়া সাঙ্গু লেকে যেতে দেয়া হয় না। এই গাইড খুব একটা গাইডও করে না। তবু এখানকার নিয়ম অনুযায়ী একজন গাইড রাখার বাধ্যবাধকতা থাকায় সিকিমের বাসিন্দাদের কিছু অর্থ আয়ের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশের চেকপোস্ট আছে। গাইডের খরচও আমাকে দিতে হবে। একা একজন পর্যটকের জন্য খরচ একটু বেশি। তিনজন বা চারজন একসাথে যেতে পারলে গাইডের খরচ এবং গাড়ির খরচ তবু কিছুটা সাশ্রয় হতো। কিন্তু উপায় নেই আমি একা এসেছি। এটিএম বুথ খুঁজলাম। টাকা তুলতে হবে। টাকা তুলে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে খেয়ে রাতে ঘুম দিলাম আরাম করে।

 

০২/০৬/২৩ তারিখ। সকালে গোসল সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। রুমে নাস্তা দিয়ে গেল রুম সার্ভিস। নীচে নামলাম। ড্রাইভার গাইডসহ আসলো। আমরা যথারীতি রওনা দিলাম সাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে। উঁচু উঁচুু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো। এমনিতে গ্যাংটক শহর খাড়া পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে। সাঙ্গু লেক যাওয়ার পথে যেন আমরা আরো উঁচু পাহাড় অতিক্রম করছি। পথে চেকপোস্ট পড়লো। গাইড অনুমতিপত্র দেখালো।

 

আমরা পাহাড় ডিক্সিগয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সাঙ্গু লেকের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সিকিমের ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ এই সাঙ্গু লেক। সাঙ্গু ভুটিয়া শব্দ। এর অর্থ হ্রদের উৎস। সিকিম রাজ্যের পূর্বদিকে অবস্থিত এই সাঙ্গু ভারত ও চিন সীমান্তের কাছে। নিরাপত্তা ব্যাপারে ভারত সরকার খুবই সতর্ক। সাঙ্গু লেক যেতে সেনাবাহিনীর অনুমতির প্রয়োজন হয়। ভারতীয় নাগরিক ছাড়া পর্যটকরা সাঙ্গু লেক অতিক্রম করতে পারে না। এর পাঁচ কিলোমিটার পরেই রহস্যে ঘেরা তিব্বত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ফুট অধিক উচ্চতায় সাঙ্গু লেক প্রতিবছর বহু পর্যটক আসে। শীতকালে পাহাড়সমূহ বরফে ঢাকা পড়ে যায়। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের মনোরম এবং সহনীয় আবহাওয়ার কারণে এমনিতে দেশিবিদেশী পার্যটকদের আনাগোনা প্রচুর। গ্যাংটকের নিকটবর্তী সাঙ্গু লেকে স্বাভাবিকভাবে পর্র্যটকদের প্রথম পছন্দ। এই সাঙ্গু লেক গ্যাংটক থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আরো ১০০০ হাজার ফুট উচ্চতায় অতিক্রম করতে হয়। ভয়মিশ্রিত রোমাঞ্চকর আঁকাবাঁকা রাস্তা ভ্রমণ করার সময় মনের মধ্যে আলাদা একটি শিহরণ জাগায়। আমরা যখন পৌঁছি তখন প্রায় দুপুর। একটি হোটেল চা খেয়ে নিলাম। একজন নেপালি মহিলা চালাচ্ছে। কয়েকজন মহিলা কর্মচারী সার্ভিস দিচ্ছে। তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে বাংলা অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য প্রাচীনকালে এই রুট ব্যবহার করা হতো। এই রাস্তার বর্তমান নাম গ্যাংটক নাথুলা হাইওয়ে।

 

সিকিম তিব্বত সীমান্তের নাম নাথুলা। তখন এই রুটের নাম ছিল সিল্ক রুট। সাঙ্গু লেক গড়ে উঠেছে পাহাড়রে বরফগলা পানি দিয়ে। সাঙ্গু শীতকালে বরফ জমে থাকে। গরমকালে এই বরফ জমা হয় লেকে। লেকটি ডিম্বাকৃতির। আয়তন ৬০ একর প্রায়। ২৭৪৩ দৈর্ঘে এবং প্রস্থে ২৭০০ ফুট। সর্বোচ্চ গভীরতা ৫০ ফুট। গড় গভীরতা ১৫ ফিট। দুই পাহাড়ের মাঝখানে এই লেকের অবস্থান। ঋতু পরিবর্তনের সাথে পানির রং বদলে যায়। বরফের সাদা রং এর বদলে নীল রং ধারণ করে। আমরা যখন গেলাম তখন এটা নীল রং এর লেক। পাহাড়ে ছেয়ে আছে আলপাইন গাছ। নানা জাতের ফুল থাকলেও রডোড্রেনের আধিক্য। রডোড্রেন সিকিমের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। আছে হিমালয়ের বিখ্যাত ইয়র্ক। যাকে আমরা বলি চেমরি গাই। পর্যটকদের কেউ কেউ শখ করে এই চেমরি গরুর পিঠে চড়ে দর্শনীর বিনিময়ে। আছে লেকের পাড়ে উঁচু পাহাড়ে উঠার কেবল রাইড কার। ৩৫০ টাকা প্রতিজনে। গাইডের উঠা ফ্রি। গাইড ছাড়া উঠা নিষেধ। আমিও উঠলাম। পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে গোটা এলাকা দেখা যায়। সেখানে অফিস আছে। আছে কফি ও নাস্তা খাওয়ার রেষ্টুরেন্ট। কতক্ষণ পাহাড়ের চুড়ায় বসে সময় কাটালাম। এর পর নীচে নেমে লেকের চারিদিকে এক চক্কর দিলাম হেঁটে। অনেক পর্যটক আছে। এর পর ড্রাইভার নিয়ে গেল সেই রেস্টুরেন্টে যেখানে প্রথমে চা খেয়েছিলাম। ড্রাইভারের নাম মনোজ কুমার রায়। গাইডের নাম সুনিল রায়। রেস্টুরেন্ট যে মহিলা চালায় তার নাম সিরিং। তার স্বামী ভারতীয় আর্মিতে চাকরি করে। কর্মচারি তিন যুবতি। প্রেমা, মানসিকা ও দিয়া। দিয়ার চেহার খুবই মিষ্টি। সদ্য তালাক প্রাপ্তা। আমি দুষ্টমি করলাম। আমার স্ত্রী নাই আমাকে বিয়ে করবে? বললো, না। বললাম অনেক টাকা দিব রাজি হয় না। প্রথমে লাখ দিয়ে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত এক কোটি প্রস্তাব দিলাম। তাও সে রাজি হয় না। চায়ের দোকানের সবাই হেসে উঠলো। সবাই জানে আমি দুষ্টমি করছি। একসাথে বসে সকলে মিলে ভাত খেলাম। আমাদের বিল আসলো ৪০০ রুপি। আমি ৫০০ রুপি দিলাম। রেস্টুরেন্টের মালিকের মেয়ে স্কুলে পড়ে সিকিমে। এখন স্কুল বন্ধ। মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছে। সেদিন বিকেলে ফেরত আসলাম। সন্ধ্যার দিকে একটু একটু বৃষ্টি হয়েছে। অনীলের সাথে দেখা করার জন্য গান্ধী মার্গে গেলাম।

 

হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি। অনিলের দোকানে বসলাম। সে ব্যস্ত। বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য বিক্রয় করে। আমিও ঘুরে ঘুরে দোকানের ভিতন দেখলাম। এটি দোতলা। একটা কোরিয়ান ছাতা কিনলাম। সে কাজে ব্যস্ত হিসাবপত্র নিয়ে। সেখান থেকে বের হতে হতে প্রায় রাত হয়ে গেল। প্রচন্ড বৃষ্টি থাকা সত্তে¡ও আমার সাথে অনিল হোটেলে আসলো। কতক্ষণ গল্পগুজব করে চলে গেল। রাতে খেয়ে ঘুমাতে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম। (চলবে)

 

নাওজিশ মাহমুদ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট