চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শুভ জন্মাষ্টমী : তত্ত্ব ও তাৎপর্য

মনোজ কুমার দেব

২৬ আগস্ট, ২০২৪ | ১২:০২ অপরাহ্ণ

ঈশ্বরকে আমরা নানা নামে অভিহিত করি। কখনো তিনি ব্রহ্ম, কখনো ভগবান। কখনো তিনি অবতার। এ সবই সর্বশক্তিমানেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ব্রহ্মরূপে ঈশ্বর নিরাকার এবং নির্গুণ। আবার যখন ব্রহ্ম জীব ও জগতের উপর প্রভুত্ব করেন তখন তিনি ঈশ্বর। নিরাকার ঈশ্বর যখন সৃষ্টির প্রয়োজনে সাকার রূপে আবির্ভূত হন তখন তিনি অবতাররূপী ভগবান। ঈশ্বর বা ভগবানকে বলা হয় অজ বা জন্মরহিত কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে সৃষ্টির কল্যাণে তিনি জন্ম নিয়ে এ ধরাকে পাপমুক্ত করেন। বৈদিক দর্শন অনুসারে বিশেষ ছয়টি গুণ হচ্ছে ‘ভগ’। এগুলো হচ্ছে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। যাঁর মধ্যে ‘ভগ’ পরিপূর্ণরূপে বিরাজমান তিনিই ভগবান। শ্রী ভাগবত পুরাণে আমরা অনেক অবতারের উল্লেখ দেখি। এগুলোর মধ্যে অনেকেই অংশঅবতার। কিন্তু বিষ্ণুর অষ্টম অবতার নামে খ্যাত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পূর্ণ অবতার, যিনি ষড়ঐশ্বর্যময়। শ্রী ভাগবতে বলা হচ্ছে ‘কৃষ্ণম্ভ ভগবান স্বয়ম্’। একই কথা ধ্বনিত হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমিয়বাণী শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় ৪র্থ অধ্যায়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্লোকে। বহুল উদ্ধৃত এ শ্লোকদ্বয়ের মর্মার্থ হচ্ছে ‘যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, অধর্মের অভ্যুত্থান হয় তখনই আমি দেহ ধারণ করি। দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করে সাধুদের পরিত্রাণের জন্য ধর্মকে সংস্থাপন করতে আমি যুগে যুগে আবির্ভুত হই’। বিখ্যাত চারযুগের মধ্যে দ্বাপরের শেষভাগে বিশেষ ক্রান্তিকালে মহাভারতের মহানায়ক শ্রীকৃষ্ণ কেন আবির্ভূত হলেন তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো।

 

দ্বাপরের শেষভাগে ধরার পাপভার লাঘবের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। ধর্মদ্বেষী এত দুর্বিনীত স্বৈরাচারী রাজার সমাবেশ এর আগে কখনো একত্রে দেখা যায়নি। হস্তিনাপুরের দুর্যোধন-দুঃশাসন, মগদের জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপালের অপশাসনে প্রজাগণ সীমাহীন দুঃখ ভোগ করছে। সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে মথুরার রাজা কংস। পিতা উগ্রসেন কারারুদ্ধ। সেনাপতি মুষ্টিক, চানুর আর প্রলম্ব, বক, তৃণাবর্ত, অঘাসুর, অরিষ্ট, দ্বিবিদ, পুতনা, কেশী, ধেনুক প্রভৃতি অসুর সহচরের দাপটে কংস ছিলো অপ্রতিরোধ্য। জরাসন্ধের দুকন্যা অস্তি ও প্রাপ্তিকে বিয়ে করে কংস আরো দুর্বিনীত। পিতা উগ্রসেন তার হাতে বন্দী হলে পুরো ভোজ, অন্ধক আর যদু বংশের প্রতিনিধিত্ব চলে আসে তার হাতে। অসংখ্য সুশাসক জরাসন্ধের হাতে বন্দী। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন কুরু, পাঞ্চাল, কেকয়, শাল্ব, বিদর্ভ, নিষধ, বিদেহ, কোশল প্রভৃতি রাজ্যে। দুটি ভাগে রাজন্যবর্গের মেরুকরণ শুরু হলো। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপট।

 

পিতৃব্য দেবকের কন্যা দেবকী ছিলেন তার স্নেহাস্পদ। দেবকীর সঙ্গে যখন রাজা সুরসেন পুত্র বসুদেবের বিয়ে ঠিক হলো, সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন রাজা কংস। সাড়ম্বরে বিয়ে দিয়ে প্রিয় বোনকে পৌঁছে দিচ্ছিলেন শ্বশুরালয়ে। কিন্তু দৈববাণী শুনেই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। আকাশবাণী হলো দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তানই হন্তারক হবে তাঁর। উদ্যত অসির হাত থেকে কোনোক্রমে বাঁচলেও দেবকীর ঠাঁই হলো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এ কারাগারেই একে একে ছয় সন্তানের জন্ম দিলেন দেবকী। অসহায় পিতা বসুদেব নবজাতক পুত্রদের তুলে দিলেন নিষ্ঠুর কংসের হাতে। যোগমায়ার প্রভাবে সপ্তম সন্তান বলরাম গেলেন বেঁচে। এবার অষ্টম সন্তানের জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে আসলেন অষ্টম গর্ভের সন্তান। রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত নিকষ এক রাতে, ঝড়-ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সময়ে। তাই এ দিনটি শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী নামে খ্যাত।

 

এবার আসা যাক, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। ভাদ্র শব্দটি এসেছে ‘ভাদ্রপদ’ নামক নক্ষত্র থেকে। ভদ্র+ষ্ণ-ভাদ্র। শুভ বা মঙ্গলের মাস। কৃষ্ণ পক্ষে চাঁদের শক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে মনই চন্দ্র। চৌদ্দটি তিথির অষ্টমীতে মনের শক্তি হ্রাস পেতে পেতে অর্ধেকে নেমে আসে। মনের চঞ্চলতা হ্রাস পেলেই সাধনার উপযুক্ত সময় হয়। মন হয় তখন অন্তর্মুখী, কামনা বাসনা মুক্ত। তখনই ভগবানকে পাওয়ার উপযুক্ত সময়। কৃষ্ণপক্ষে জন্ম নেয়া শিশুটি কালো। কিন্তু জগতকে তাঁর আলোয় আলোকিত করলেন। মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ সাথে মন, বুদ্ধি ও অহংকার- এ অষ্টতত্ত্ব নিয়েই আমাদের জীবপ্রকৃতি। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ অষ্টপ্রকৃতির অতীত। তাই অষ্টমীতেই তাঁর আগমন। আবার যোগমার্গেও আমরা দেখি সাধনার আটটি স্তর। এক একটি স্তর পর পর সাধকের জীবনে আসে। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান আর ধারণার পরেই সাধক হন সমাধিস্থ’। তখনই হয় ভগবতদর্শন। এক একটি সাধনস্তর শেষ করেই অষ্টম স্তরেই পাওয়া যায় পরম আকাঙ্ক্ষিত ভগবানকে। ‘কংস’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কম্+স। কম্ মানে কামনা-বাসনা। আমাদের এ দেহ কামনা বাসনার কারাগার। ভগবানের কৃপা লাভ ছাড়া দেহ কারাগারের বদ্ধ দুয়ার খোলা সম্ভব নয়। কৃষ্ণের পিতা বসুদেব। ‘বসু’ অর্থ প্রাণ অর্থাৎ জীবাত্মা। মা দেবকী হলেন দৈবশক্তি। অরাজক মথুরার ভয়ংকর কারাগার থেকে নবজাতক কৃষ্ণ স্থানান্তরিত হলেন নন্দালয়ে। নন্দালয় হলো আনন্দের আলয়, যেখানে রয়েছেন মা যশোদা। ‘যশোদা’ শব্দটি এসেছে যশ্ অর্থাৎ ভগবতমহিমা থেকে। মা যশোদা তাই যশোদাত্রী। যমুনায় পথ প্রদর্শনকারী শৃগাল ‘শিবা’ শিবশক্তির প্রতীক। অভয়দানকারী ফণাধারী অনন্তনাগ ‘কুন্ডলিনী’ শক্তির প্রতীক। বসুদেব জীবাত্মা, মস্তকে ধারণ করলেন পরমাত্মা ভগবানকে, হলেন শ্রেষ্ঠ ভগবদভক্ত। দ্বাপরের শেষভাগে ধরার পাপভার লাঘবের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমাদের জীবনও নানা পাপভারে বিপর্যস্ত। ভগবানের জন্ম শুধু একবার হয়েছে তা কিন্তু নয়। একজন সাধকের অন্তরে বারবার ভগবানের জন্ম হতে পারে। ভগবানের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলতে হলে প্রয়োজন জন্মাষ্টমী উৎসব উদযাপন। উৎসব সবাইকে উচ্চস্তরে উত্তীর্ণ করুক, ভক্তের চিত্তকে রাঙিয়ে দিক। আত্মার উর্ধ্বায়ন হোক। আমাদের জীবনে কল্যাণ ও পরমানন্দ বয়ে আনুক।

মনোজ কুমার দেব অধ্যক্ষ, প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজ।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট