
‘রিজার্ভ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা। একটি দেশে ভবিষ্যতের জন্য যে অর্থ সংরক্ষণ করা হয়, সে অর্থ দেশটি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঋণ বা অন্য কোন কাজে খরচ করতে পারে না। রপ্তানী, রেমিটেন্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানী, ঋণ, সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেয়ার পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অর্থনীতির পরিভাষায় রিজার্ভ মানে সঞ্চয়। দেশের ভিতরে অর্থ লেনদেন হলে সেটি হয় টাকার মাধ্যমে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে কোন ব্যবসার চুক্তি হলে সেটির লেনদেন হয় ডলারে কিংবা রিজার্ভের সঞ্চয় থেকে। ধরুন, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক লেনদেন হলো। সেখানে চীনের কারেন্সি এবং বাংলাদেশের কারেন্সি ভিন্ন। তাহলে তারা কিসে পেমেন্ট নেবে। অবশ্যই ডলারে এবং এই ডলারটি হলো বাংলাদেশের জন্য রিজার্ভ। সাধারণত বেশীর ভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্র্রের মুদ্রা ডলারে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখে। এ ছাড়া ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো, চীনা রেনমিনবি বা চীনা ইয়েন, জাপানী ইয়েন, বৃটিশ পাউন্ড, সুইস ফ্রাঁও জমা রাখা হয়।
সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা, যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য ইংরেজীতে একে বলা হয় হার্ড কারেন্সি। যেমন, ডলার, ইউরো, পাউন্ড ইত্যাদি। অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশকে যে টাকা পাঠানো হয় সেটি একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাঠানো হয়। এই টাকাগুলোই মূলত রিজার্ভ। রিজার্ভ সমৃদ্ধ থাকে আমেরিকাতে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে এই টাকা সংগৃহীত থাকে। কোন দেশ স্বীয় দেশেরই কোন ব্যাংকে বা বিদেশে অবস্থিত কোন ব্যাংকেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত সংরক্ষণ করতে পারে।
রিজার্ভ কি কাজে লাগে?
ক) পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছাড়া একটি দেশ জ্বালানী তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরী পণ্য আমদানী করতে পারে না। খ) একটি দেশের বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় রিজার্ভ থেকে। গ) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মুদ্রার বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার মাধ্যমে মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক রাখে। ঘ) দেশের আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলা, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রানীতি শক্তিশালীকরণ, বাজেট বাস্তবায়ন, বৃহৎ প্রকল্পের অর্থের জোগান সহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে এ ধরনের রিজার্ভ হাতে রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঙ) সংকটকালে দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস জোগায়।
রিজার্ভের মজুত কিভাবে গড়ে উঠে : ক) পন্য ও সেবা রপ্তানী, খ) বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের স্বদেশে পাঠানো অর্থ ইংরেজীতে যাকে বলা হয় রেমিটেন্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ১০.৬৬ শতাংশ বেশী (দি ডেইলী স্টার ডট নেট,০২-০৭-২৪)। গ) বৈদেশিক ঋণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অর্থ।
রিজার্ভ কমপক্ষে কত থাকা উচিত : কোন দেশের রিজার্ভ দিয়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানী ব্যয় মিটানোর সক্ষমতা থাকা জরুরি। বিশ্বের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে চীনের কাছে। ২০২২ সালের জুনে দেশটির রিজার্ভ এর পরিমান ছিল ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৯ কোটি মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। মাত্র আড়াই বছর আগে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন। বর্তমানে ব্যয়যোগ্য নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৩ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ এর শর্তানুযায়ী জুন,২৪ শেষে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ১৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার (ভোয়া বাংলা ডট কম, ২৯-০৫-২৪)।
রিজার্ভ সংকট কি : এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে(আকু) মার্চ ও এপ্রিল মাসের দায় মেটানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মোট রিজার্ভ কমে ২৩.৭৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আইএমএফ এর হিসাব বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১৮.৩২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার। তবে প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কিছু কম বলে জানা গেছে। প্রকৃত রিজার্ভ সেটাই, যার বিপরীতে কোন দায় নেই এবং যে কোন সময় তা ব্যবহার করা যায় (প্রথম আলো,১৫-০৫-২৪)। কোন দেশে তিন মাসের মোট আমদানী ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকলে সেটা মোটামুটি নিরাপদ। আন্তর্জাতিক স্ট্রান্ডার্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ছয় মাসের বেশী আমদানী দায় মেটানোর মতো অর্থ থাকাকে অধিক নিরাপদ বিবেচনা করা হয়। আর রিজার্ভে তিন মাসের কম আমদানী ব্যয় মেটানোর মতো অর্থ থাকলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি প্রতিমাসে প্রায় সোয়া ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানী ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অতএব তিনমাসের আমদানী ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশের লাগবে ১৫.৭৫ বিলিযন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে ১৩ বিলিয়ন ডলার। অতএব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রিজার্ভ বর্তমানে সংকটে রয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘রিজার্ভ সংকট’। বর্তমানে নীট রিজার্ভ রয়েছে ১৪.৭৯ কোটি ডলার যা দিয়ে ১.৮ মাসের আমদানী ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। রিজার্ভকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে তিন মাসের আমদাণী ব্যয়ের সমপর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। গ্রস রিজার্ভ তিন মাসের আমদানী ব্যয়ের সমান করতে হলে বাংলাদেশকে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। নিট রিজার্ভ তিন মাসের আমদানী ব্যয়ের সমান করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরও তিন বছর। অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে গ্রস রিজার্ভ এবং ২০২৭ সালের জুনে নিট রিজার্ভ তিন মাসের আমদানী ব্যয়ের সমান হবে (যুগান্তর, ২৫-০৬-২৪)।
ডলার সংকট কি : ডলার হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা, যা সারা বিশ্বের প্রায় সকল দেশ লেনদেনের জন্য ব্যবহার করে। সংকট বলতে বুঝায় চাহিদার চেয়ে জোগানোর স্বল্পতা। প্রতিটা দেশ আমদানী এবং রপ্তানীর জন্য ডলার ব্যবহার করে থাকে। কোন দেশের আমদানীর জন্য যে পরিমাণ ডলার প্রয়োজন হয় রপ্তানী বা অন্যান্য উৎস থেকে সেই পরিমাণ ডলার দেশটি যদি আয় করতে না পারে তবে এ ক্ষেত্রে বলতে হবে দেশটিতে ডলার সংকট হয়েছে। তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে দেশে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬০ শতাংশ। আর গত দুই বছরেই অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা। আর ২০২১ সালের জানুয়ারীতে ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। একই বছর যখন দেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় সে সময় ছিল ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা। ২০২২ সালে ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠে। খোলাবাজারে প্রথমবারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার দর ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। (চলবে)
ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।
পূর্বকোণ/এসএ