
করোনা মহামারীর পর সৌদি আরবে হজের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে। আমাদের দেশেও টাকার মান হ্রাস এবং বিমানভাড়া বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৫ শত জন এবং গত হজে (২০২৪) তিন ভাগের এক ভাগ তথা ৪৪ হাজার জনের কোটা খালি যায়। এতে সাগরপথে হজযাত্রী পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা সামনে চলে আসে। বাংলাদেশ বিমান প্রতি হাজী থেকে ভাড়া নিয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সাগরপথে হজযাত্রী পাঠালে যাতায়াত আকাশপথের চেয়ে এই খরচ অর্ধেক নেমে আসতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে এখনি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু আর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হজনীতি ঘোষণা হবে, শুরু হয়ে যাবে হজকার্যক্রম। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলের ৫৩ বছর তথা বিগত ৭৫ বছরের ব্যবধানে হজের এমন প্রতিকূলতা আসেনি। কোটার উপর চাপ থাকত, হজযাত্রী অতিরিক্ত থাকায়। কিন্তু করোনা মহামারীর পর থেকে হঠাৎ করে হজের খরচ বেড়ে যায়।
সৌদি সরকার তথা হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজায়। বিগত ১৪ শত বছরের মোয়াল্লেমপ্রথাকে নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে সার্ভিস সেন্টার। মোয়াল্লেমগণের ক্ষমতাব্যবস্থাপনা গৌণ করে দেয়া হয়েছে; যদিওবা তারা সৌদি আরবের নাগরিক। যে কোন ব্যবস্থাপনায় ভাল মন্দ থাকবে; তেমনি মোয়াল্লেমগণের ব্যবস্থাপনায়ও থাকবে স্বাভাবিক। মোয়াল্লেমগণের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থাপনা আপত্তি অভিযোগ না থাকার কথা নয়। ফলে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জেদ্দা হজ টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, হজযাত্রী পরিবহনে বাস ব্যবস্থাপনা, মিনা আরাফাতে তাঁবুর ব্যবস্থাপনা, খাবার সরবরাহের ব্যবস্থাপনা, জায়গায় জায়গায় হজযাত্রীগণকে সেবা দিতে খাদেম তথা কুলি ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন ঠিকাদার কোম্পানীকে দিয়ে দিয়েছে।
হজ বিষয়ে দীর্ঘসময়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এতে হজের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে, তার বিপরীতে হজযাত্রীর আরাম দেখলাম দুটি। ১) হজ টার্মিনাল পার হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, যা ১৯৮৩ সালে বিমানবন্দর চালু হওয়া থেকে দীর্ঘসময় ছিল না। ২০২২ সাল থেকে ব্লক ব্লক করে এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২) নতুন বাস আমদানী করে আরামদায়ক ব্যবস্থা করা হয়। বাকী সব কিছুতে আগের ব্যবস্থাপনা ভাল ছিল বলা চলে। অপরদিকে বাংলাদেশে ডলারের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়া এবং হজযাত্রী বিমানভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ হওয়ায় হজের সর্বনিম্ন ব্যয় প্রায় ৬ লাখ এসে দাঁড়ায়। যা করোনা মহামারীর আগে ২০১৯ সালে এর অর্ধেক ৩ লাখ টাকা বা এর চেয়ে ১০/২০ হাজার কম দিয়েও হজ করা যেত। বাংলাদেশের কোটা ১ লাখ ২৭ হাজার জন। এ রকম কোটা পূর্ণ না হওয়ার ঘটনা ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ বড় বড় মুসলিম দেশগুলোতে হয়েছে বলে মনে হয় না। এতে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। চট্টগ্রামে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের সামুদ্রিক বন্দর। সাথে পাহাড়তলী স্থায়ী হাজীক্যাম্প তো আছেই। অতএব সাগরপথে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য কয়েকটি পানির জাহাজ ব্যবস্থা করার জন্য এখনই উদ্যোগ প্রয়োজন। তা করতে পারলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি অনেক বেড়ে যাবে। আগে জাহাজের গতি ছিল কম। যুগ অবস্থার প্রেক্ষাপটে পানির জাহাজের গতিও বেড়ে গেছে। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাত এবং বাংলাদেশ আমলে হিজবুল বাহার জাহাজে চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা যেতে সময় লাগত ১৩ দিন বা কম বেশি। যাবতীয় কিছুতে প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা উন্নত হওয়ায় এখন ৭/৮ দিন বা কম বেশি সময় সাগরপথে চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা পৌঁছা সম্ভব বলে মনে করি।
পাহাড়তলী হাজীক্যাম্প: ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক পাহাড়তলী হাজীক্যাম্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই সময় চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে কিছুটা দূরত্বে পাহাড়তলী ট্রেন স্টেশনকে লক্ষ্য রেখে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ককে সামনে রেখে পাহাড়তলী হাজীক্যাম্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকা কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে যে কোন ট্রেন যাওয়া আসাকালে পাকিস্তান আমলে তেজগাঁও ট্রেন স্টেশনে থামত। বর্তমানে বিমান বন্দর স্টেশন যেমনটা ভূমিকা রাখছে। শহরের অপরপ্রান্তে যাত্রীগণের কল্যাণে তেমনিভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ট্রেন যাওয়া আসাকালে পাহাড়তলী ট্রেন স্টেশনে থামত কয়েক মিনিটের জন্য। ৯ একর ৩৫ শতকের বিশাল এরিয়া নিয়ে এ হাজী ক্যাম্প। প্রধান ফটক সম্মুখে রেখে বিশাল আকারের চত্বর নিয়ে উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি দ্বিতল বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন। এর কিছুটা উত্তরে মহাসড়কের একদম নিকটে একতলা বিশিষ্ট প্রকান্ড মসজিদ। মসজিদের পশ্চিম সংলগ্ন প্রায় ১০ শতক এরিয়া নিয়ে এলাকাবাসী ও হাজীদের কবরস্থান। নিয়মতান্ত্রিক দূরত্ব বজায় রেখে হজযাত্রীগণের সাময়িক অবস্থানের নিমিত্তে ৭টি দ্বিতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন। তৎমধ্যে একটি ভবনের নিচতলায় সম্মুখভাগে পাহাড়তলী হাজীক্যাম্প পোস্ট অফিস। ঐ সময় একজন হজ অফিসার, একজন সহকারী হজ অফিসার, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ১৫/২০ জন লোক সারা বছর কর্মরত থাকত দ্বিতল বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনে। পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে হজ ছিল নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকা থেকে হজ ফ্লাইট চালু হলেও যাবতীয় কিছু নিয়ন্ত্রণ হত পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প থেকে। দেশের যাবতীয় কিছু ঢাকা কেন্দ্রিক মানসিকতার ফসল হিসেবে ঢাকা বিমান বন্দরের বিপরীতে আশকোনা হাজী ক্যাম্পে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পের কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় ১৯৮০ এর দশকে। প্রায় ৩০ বছরের উৎসবমুখর পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। রেলসহ একাধিক সদর দপ্তরও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত, পাকিস্তান থেকে আকাশপথে হজে গমন করা হলেও ভারতের হজের প্রধান দপ্তর মুম্বাই। পাকিস্তানের প্রধান দপ্তর করাচি। উপমহাদেশের বড় বড় অপর দুটি দেশে মুম্বাই, করাচি থেকে হজের সদরদপ্তর দিল্লি, ইসলামাবাদ সরানো হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের প্রতি অবিচার করা হল। ইহা সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন। সুলতানী আমল থেকে ভারতবর্ষে হজ্বের ইতিহাস বলতে পশ্চিমে মুম্বাই, পূর্বে চট্টগ্রাম। বাংলার ঢাকাও নয়, কলকাতাও নয়। ঢাকার ইতিহাস ৪ শত বছর, কলকাতার ইতিহাস সাড়ে ৩ শত বছর। চট্টগ্রামের ইতিহাস কমপক্ষে হাজার বছরের বেশি।
দেশ ছোট হতে পারে, তবে দেশের মূল্যায়ন হয় জনসংখ্যা নিয়ে। জনপ্রতিনিধি নির্ণয় হয় জনসংখ্যা দিয়ে। বিশ্বের বুকে হজযাত্রীর সংখ্যার দিকে দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ১. ইন্দোনেশিয়া ২. ভারত ৩. পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রাদেশিক শহরে রয়েছে স্থায়ী হাজী ক্যাম্প, এই শহরের বিমান বন্দর দিয়ে হজযাত্রী যাওয়া-আসা করছে। অনুরূপভাবে ভারতেও। ভারতের কলকাতা, গুহাঠিতে রয়েছে স্থায়ী হাজী ক্যাম্প। এই দুই শহরের বিমান বন্দর দিয়ে হজ্বযাত্রী যাওয়া-আসা করছে। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী আগরতলায়ও স্থায়ী হাজী ক্যাম্প রয়েছে। সোনারগাঁও এর ধর্মপ্রাণ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পালতোলা জাহাজে হজযাত্রী প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বিহারের ভারতবর্ষের অন্যতম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত ইয়াহিয়া মানেরীর অন্যতম খলিফা হযরত মোজাফ্ফর শাহ বলখি সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের নিকট চিঠি লিখেন তাকে যেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হাজীদের প্রথম জাহাজে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চট্টগ্রামের যেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সামুদ্রিক বন্দর, তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দর। হজযাত্রীর কল্যাণে চট্টগ্রামের গৌরবোজ্জল ইতিহাসকে সম্মান দেখিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ অফিস হিসেবে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পকে চালু করা হোক। সাগরপথে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ হজযাত্রী যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করা হোক। অপরদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের শতাধিক হজ এজেন্সী হাজারও কর্মকর্তা-কর্মচারী হজ বিষয়ে যাতে ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়, তেমনি এ অঞ্চলের কোন হজযাত্রী যাতে ঢাকা হয়ে হজে যেতে না হয়। পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যাতে সাগরপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে, আকাশপথে হলে বিমান বন্দর দিয়ে হজে যাতায়াত করতে পারে।
চট্টগ্রামে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদ। সম্পূর্ণ আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ অরাজনৈতিক সংগঠন। কোন ব্যবসায়িক কাফেলা এজেন্সী নয়। চট্টগ্রাম থেকে সাগরপথে হজ্বযাত্রী গমনে ব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ অফিস হিসেবে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প চালু করতে হজযাত্রী কল্যাণ পরিষদ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতএব উপরোক্ত বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আহমদুল ইসলাম চৌধুরী প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।
পূর্বকোণ/এসএ