আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্ববহ। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে, ‘আওয়ামী লীগ যদি মনে করে থাকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েও আগামী নির্বাচন একতরফাভাবে করে পার পেয়ে যাবে, তাহলে বড় ভুল হবে। ভারত, চীন কিংবা রাশিয়ার সমর্থনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না।’ (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২৩)। দেশ-জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে তিনি বারবার আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে পুনরায় একতরফা নির্বাচনের ভয়ানক সম্ভাব্য পরিণতিসমূহ বর্ণনা করে যাচ্ছেন। ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখ প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলা’ পত্রিকায় অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবনতির কতিপয় কারণ উল্লেখ করেন, যেসবের মধ্যে রয়েছে প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গ, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি প্রসঙ্গ, কোয়াড প্রসঙ্গ। নড়বড়ে সম্পর্কের পরিণতি হিসেবে তিনি মনে করছেন বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখে না, কারণ ২০২১ সালের ৯-১০ ডিসেম্বর গণতন্ত্র সম্মেলনে পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১১০টি দেশ আমন্ত্রিত হলেও বাংলাদেশ বাদ পড়ে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শনের কারণে ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ প্রলম্বিত হয়, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে। তাঁর মত আরও অনেকে একতরফা নির্বাচনের কুফল বর্ণনা করে যাচ্ছেন, যদিও এ ব্যাপারে যাঁদের ভাবা উচিত তাঁরা খুব বেশি তোয়াক্কা করছেন না। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার বিদেশিরাও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অধিক তৎপর। তাদের তৎপরতা বন্ধে মন্ত্রীপর্যায় থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে এ মর্মে যে, নির্বাচনের পূর্বে বিদেশিরা আর কোনো কথা বলবে না। প্রফেসর মইনুলদেরকেও হয়ত এমন বয়ান শুনতে হতে পারে। আওয়ামী লীগের জানা উচিত, প্রফেসর মইনুল ইসলাম আওয়ামী বিরোধী ব্যক্তি না। আওয়ামী লীগকে তিনি ক্ষমতায় দেখতে চান না বিষয়টি এমনও নয়, বরং আওয়ামী লীগের বর্তমান ভূমিকার কারণে যদি সত্যি সত্যি দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তবে দলটি সাধারণ জনতার রোষানলে পড়তে বাধ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের কাছে দাবি করছে, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটির রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগার ভরছে। জুলিয়া ব্লেকনার আরও বলেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অংশীদারদের বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত যে, সরকারের কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়ন ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপন্ন করবে। (দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩ থেকে অনুবাদকৃত)। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, কূটনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে একক দেশ হিসেবে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বৈদেশিক সাহায্য, প্রবাসী আয়, উচ্চশিক্ষাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশ নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। গত পঞ্চাশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের বার্ষিক প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির শতকরা ৮৫ ভাগই তৈরি পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট, আর তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি পোশাকবাবদ মোট আমদানির শতকরা ১০ ভাগ ব্যয় করে বাংলাদেশি পোশাকে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ রপ্তানির তুলনায় আমদানি করে বেশি এবং বিশাল বাণিজ্যঘাটতি মোকাবেলা করে প্রবাসী আয় দ্বারা। প্রবাসী আয় বাদেও বৈদেশিক মুদ্রার অপর দুটি উৎস হল সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং বৈদেশিক ঋণ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ২০ ভাগ, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের শতকরা ১৯ ভাগ এবং প্রবাসী আয়ের শতকরা ১৬ ভাগ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ শতকরা ৪ ভাগেরও কম।
বাংলাদেশের রপ্তানির দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যা ইউরোপের ২৭টি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট। মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৪৫ ভাগ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। ইইউতে বাংলাদেশ গড়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করে, যদিও আমদানির পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারের কম। ইইউ থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ৬৩ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে প্রথম অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, এর পর যথাক্রমে যুক্তরাজ্য এবং ইইউ। যে-সব অঞ্চলে বাংলাদেশের রপ্তানি বেশি কিন্তু আমদানি কম তাদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ। বিগত অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানির তুলনায় যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি অনেক কম। একই সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে আমদানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের মত। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি এবং শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্যে বসবাস করে বিধায় অর্জিত রেমিটেন্সের পরিমাণও বেশ ভালো। গত পাঁচ দশকে দেশটি বাংলাদেশকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তায় জাপান সবার শীর্ষে। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত জাপান প্রদত্ত আর্থিক সহায়তার পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উন্নয়ন সহায়তায় এগিয়ে থাকলেও জাপানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্য নেতিবাচক। ২০২১-২২ অর্থবছরে জাপান থেকে ২.৭৭ বিলিয়ন ডলার আমদানির বিপরীতে জাপানে রপ্তানি হয়েছে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে। গত অর্থবছর চীন থেকে আমদানির পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানির পরিমাণ পৌনে ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বরাবরই চীনের সাথে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্যঘাটতি থাকে। চীন থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর চীন থেকে নমনীয় শর্তে ঋণ নিয়ে মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়া কিংবা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চীনা ঋণের আরেকটি বড় অসুবিধা হল তাদের ঋণ ব্যবহার করে তাদের ঠিকাদারের মাধ্যমেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। ভারতের ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রেও তাদের ঠিকাদারদের কাজ দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ১১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। দেশে মোট আমদানির শতকরা ২৫ ভাগ আসে চীন থেকে এবং ১৮ ভাগ ভারত থেকে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক সর্বমোট ৬২টি দেশকে ঋণ দেয়, তন্মধ্যে সর্বাধিক ঋণ গ্রহীতা দেশ বাংলাদেশ। উক্ত ব্যাংক হতে বাংলাদেশের চুক্তিকৃত ঋণের পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলার এবং ছাড়কৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আঞ্চলিক যোগাযোগ, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের মত অমীমাংসিত বিষয়ের কারণে ভারতীয় ঋণের সুফল বাংলাদেশ তেমন ভোগ করেনি। তাছাড়া ঋণের শর্ত হিসেবে ভারতীয় ঠিকাদারদের কার্যাদেশ প্রদান এবং ভারত থেকে প্রকল্পের সিংহভাগ পণ্য বা সেবা কেনার কথা রয়েছে। চীন এবং ভারতের পর বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রাজিল, কাতার এবং সৌদি আরব থেকে।দুর্ভাগ্যবশত আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উন্নয়ন অংশীদার প্রধান দেশগুলো অযাচিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের উন্নয়নে যাদের অবদান কম তারাও বাদ পড়ছে না। যেমন রাশিয়া এমন দেশ যার সাথে সরাসরি ব্যাংকিং লেনদেন চালু নেই, অন্য দেশের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়। সেই রাশিয়াও আজকাল আমাদের রাজনীতি, নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের মত। রাশিয়ার নিকট থেকে উচ্চসুদে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে রাশিয়ার কোম্পানির মাধ্যমেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, লাভ-ক্ষতির বিচারে যেটি বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর হতে দীর্ঘসময় লেগে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে বার্ষিক গড়ে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মধ্যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি হয় কমবেশি ১০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্র হতে আমদানি অনেক কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে চীন থেকে আমদানির পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি সে জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারের কম। সুস্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগেও (এফডিআই) যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে। ২০২৩ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের স্থিতি ২০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহায়তা প্রদানেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে। করোনা মহামারি মোকাবেলায় দেশটি বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ১১ কোটি ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কোভিড-১৯ বিশেষ আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশিদের অভিবাসন পছন্দের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার। গত কয়েক বছরে বেশকিছু শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেছে, তাদের অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে ভালো চাকরি-বাকরির সুযোগ করে নিচ্ছে। সর্বশেষ দু-তিন বছরের উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বার্ষিক গড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহে সৌদি আরবের পরই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।
সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতির শক্ত ভিত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহিত নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক অটুট থাকা আবশ্যক। কিন্তু সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকর্তৃক প্রত্যাশিত বিবিধ নিয়মনীতি পরিপালন অপরিহার্য। উদাহরণ হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত করতে অবাধ সুষ্ঠু ভোট এবং শ্রমিক অধিকার-সম্পর্কিত যে-সব নীতির কথা যুক্তরাষ্ট্র বলছে তা আমলে আনার মধ্যে কোনো অকল্যাণ আছে কেউ বলতে পারবে না। ২০২৬ সালে এলডিসির তালিকা থেকে বের হলে আমাদের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দরকার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবাধীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং বিশ্বব্যাংকের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার আনুকূল্য না পেলে এসব সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে না। অবশ্যই দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশ আরোপিত কোনো বিধিনিষেধ আমরা মানতে বাধ্য নই কিংবা মানার জন্য কোনো মহলও বলছে না।
দেশের অর্থনীতি বহুবিধ সংকটে নিমজ্জিত। প্রায় শতকরা ১০ ভাগ মূল্যস্ফীতি, মাত্র সাড়ে ১৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অপর্যাপ্ত রাজস্ব আয়, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, তারল্যবিহীন নিস্তেজ শেয়ার বাজার এসবকিছু নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সবার জন্যই উৎকণ্ঠার। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল গত ৫১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এবং আমদানি ব্যয় যথাক্রমে ৫৫.৬ বিলিয়ন ডলার এবং ৭৫.০৬ বিলিয়ন ডলার। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এবং সাহায্য সহযোগিতা হারালে তার পরিণতি হবে ভয়ানক।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘আমাকে বাঁচাতে হলে, আমার জনগণকে বাঁচাতে হলে, আমার গার্মেন্টসকে বাঁচাতে হলে, আমার সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে, যে দাবিটা আমাদের জনগণের এবং পাশাপাশি বাহিরের, ওরা খুব বেশি দাবি করেনি, ওদের একটাই দাবি যে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হতে হবে। কোনো রকম কারচুপির আশ্রয় নেওয়া যাবে না।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০২৩)। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন মূল্যায়ন সাধারণ জনগণের মাঝে কিছুটা আশা জাগায়- হয়ত তিনি চেষ্টা করবেন কীভাবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা যায়। তিনি আরও বলেন, জনগণকে বলতে হবে নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হয়েছে তবেই তা হবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? যদি বলেন, বিএনপিকেতো নির্বাচনে আসতে বলা হচ্ছে-তাও কি গ্রহণযোগ্য দাবি? ইতিপূর্বে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গত ২৬ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ দেশটির বিরোধী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের লক্ষ্যবস্তু করছে, যেটির মূল উদ্দেশ্য হল বিরোধীদলবিহীন একটি প্রতিযোগিতাশূণ্য নির্বাচন। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একটি পূর্বপরিকল্পিত সমাবেশের পর থেকে প্রায় ১০ হাজার বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চলমান সহিংসতায় পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের অধিক মানুষ আটক আছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার ও ভিডিও বিশ্লেষণ দ্বারা এইচআরডব্লিউ প্রমাণ পেয়েছে, সাম্প্রতিক নির্বাচনসংক্রান্ত সহিংসতার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ী। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে চলমান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দমন-নিপীড়নের মধ্যে অবাধ নির্বাচন অসম্ভব। কিন্তু আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না। আমরা চাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কারণ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে যে মাত্রার অর্থনৈতিক ধস নামবে ঐ মাত্রার ধস ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।