চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

মহান সাধক শাহসুফি হযরত শাহ্ আমানত (রা.)

আবুল কাসেম ভূইয়া

২ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০২ পূর্বাহ্ণ

বারো আউলিয়ার পুণ্য এবং ধন্যভূমি চট্টগ্রামের আবাদ এবং এখানে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর আউলিয়া ফকির দরবেশের মাধ্যমে। সুদূর আরব এবং ভারত থেকে কিছু পীর আউলিয়া, ফকির, দরবেশ চট্টগ্রাম এসেছিলেন মানবকল্যাণ এবং ইসলাম প্রচারের জন্য। চট্টগ্রামে আগত পীর, আউলিয়া, ফকির-দরবেশদের মধ্যে হযরত বদর শাহ (রা.), হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রা.), হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রা.), হযরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রা.), হযরত শেখ ফরিদ (রা.) হযরত শাহ গরীব উল্লাহ শাহ (রা.) হযরত বদনা শাহ (রা.) প্রকাশ শফি শাহ (রা.), হযরত আনার উল্লাহ শাহজী (রা.), হযরত শাহ চান্দঁ আউলিয়া (রা.), হযরত শাহ আমানত (রা.) সহ অসংখ্য পীর আউলিয়া রয়েছেন। তাঁদের আগমনে চট্টগ্রাম ধন্য হয়েছে। চট্টগ্রামের সুফিদের আসন কখনো খালি ছিল না এখনো খালি নেই। রাজা বাদশাহরা যেমন পার্থিব ব্যাপারে রাজত্ব করেন তেমনি সুফিদের মতে সুফিরা ধর্মরাজ্যের রাজা। সুফিরা পৃথিবীর সব ধরনের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেন। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ায় আল্লাহ তাঁদের সুপারিশ গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে আগত পীর আউলিয়া, ফকির দরবেশদের মধ্যে হযরত শাহ আমানত ছিলেন অন্যতম।
চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক বেলায়েত রক্ষা, ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানবকল্যাণ করার জন্য তিনি সুদূর ভারত থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। হযরত শাহ আমানত (রা.) এর চট্টগ্রামে আগমন সম্পর্কে সঠিক সময় জানা না গেলেও ধারণা করা হয় নিশ্চিতভাবে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের পরে তিনি চট্টগ্রাম এসেছিলেন। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। হযরত শাহ আমানত (রা.) এর পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল ইরাকে। তিনি বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.) এর বংশধর ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হযরত নিয়ামত শাহ (রা.)। ভারতের বিহারের প্রখ্যাত সাধক সুফি হযরত মোনামেয় পাকবাচ তাঁর ঘনিষ্ট আত্মীয় ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ বংশ পরম্পরায় বুজুর্গ ছিলেন।
মোঘল সম্্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রথম ভারতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে পীর আউলিয়া, ফকির দরবেশগণ তৎপর ছিলেন। ঠিক সেই সময় ভারতের কাশ্মির, পাটনা, লৌক্ষ, মুর্শিদাবাদ ছিল সুফি দরবেশদের মিলন ক্ষেত্র। এসব স্থান থেকে সুফি দরবেশগণ বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। তৎকালীন সময়ে মহান সাধক সুফি হযরত শাহ আমানত (রা.) ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং আল্লাহর সাধনায় নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। সংসারের সমস্ত মায়া-মমতা ত্যাগ করে তিনি আধ্যাতিœক জ্ঞান অর্জনের জন্য বিহার থেকে কাশ্মির চলে যান। কাশ্মিরে গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সাধক পীর হযরত শহীদ (রা.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি তাঁর পীরের কাছে অবস্থান করে আধ্যাতিœক জ্ঞান অর্জন এবং সাধনা করে আধ্যাতিœক জগতের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর পীর তাঁকে বেলায়েতের সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করেন এবং তাঁকে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানবকল্যাণের পথে নিজেকে নিয়োজিত করার উপদেশ দেন।
হযরত শাহ্ আমানত (রা.) চট্টগ্রামের বেলায়েত রক্ষা এবং ইসলাম প্রচারের জন্য সুদূর বিহার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তিনি চট্টগ্রামে এসে নিজের পরিচয় গোপন রেখে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং-এ পাখা টানার চাকুরী গ্রহণ করেন। দিনের বেলায় তিনি চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং এ চাকুরী করতেন আর রাতের বেলায় লালদীঘির পূর্ব পাড়স্থ নিজস্ব ছোট্ট কুঠিরে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। তিনি চট্টগ্রামে অবস্থানকালে ইসলাম প্রচারের কাজ করতেন এবং মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সবসময় দুঃস্থ অসহায়ের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। তিনি সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। তাঁর আচার ব্যবহার, চলাফেরা, কথাবার্তায় অমায়িকভাব থাকার কারণে লোকজন তাঁকে মিয়া সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। অল্প আহার অধিক এবাদত করা ছিল তার করণীয় কার্র‌্যাবলীর মধ্যে অন্যতম।
ভক্তদের তিনি হালাল উপার্জন, সৎ জীবন যাপন, সংযমী এবং এবাদতে মশগুল থাকার পরামর্শ দিতেন। মানবকল্যাণ করতে গিয়ে তাঁর প্রচ- আধ্যাতিœক শক্তি প্রকাশ পায়। তাঁর আধ্যাতিœক শক্তির পরিচয় পাওয়ার পর তিনি আর চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং-এ চাকুরী করতে পারেননি। তিনি চাকুরী ছেড়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানবকল্যাণে নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত করেন। তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা দেখে মানুষ মোহিত হয়ে যেত। দলে দলে তাঁর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকে। তিনি কাউকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। তিনি ধনী-গরীবের মধ্যে কোন সামাজিক ব্যবধান সহ্য করতে পারতেন না। কষ্টার্জিত আয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকাটা তিনি বেশী পছন্দ করতেন। তিনি সবসময় এহরামের কাপড়ের মত সাদা কাপড় পড়তেন। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইসলাম এবং মানবতার কল্যাণ করে ১১৮৭ হিজরীর ৩১ জেলক্বদ তারিখে ১২৫ বছর বয়সে ইন্তেকালের পর তাঁকে লালদীঘির পূর্বপাড়স্থ খানখাহ শরীফে সমাহিত করা হয়। তাঁর মাজার শরীফ হচ্ছে চট্টগ্রামের তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে হাজার হাজার ভক্ত নারী-পুরুষ আসেন তাদের নিজ নিজ মনোবাসনা নিয়ে। তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে সমস্ত কর্মকা- শরীয়ত মতে হয়ে থাকে। শরীয়তবিরোধী সমস্ত কর্মকা- এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুঃস্থ গরীব-অসহায়দের জন্য দু’বেলা লঙ্গরখানার ব্যবস্থা রয়েছে। মাজার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেবামূূলক কর্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট