
রক্ত মানবশরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তৈল বা বিদ্যুৎ ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না তেমনি রক্ত ছাড়াও মানুষের জীবন বাঁচে না। রক্তস্বল্পতাও বহু রোগ ও শারীরিক কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। অস্ত্রোপচারসহ অন্তত বারোটি রোগের চিকিৎসায় রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের অভাবে অনেক সময় রোগী মারা যায়। বিশেষত ব্লাড ক্যানসার, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, রক্তশূণ্যতা, ডেঙ্গু, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, একজন সুস্থ মানুষ; যার বয়স আঠারো বছরের নিচে নয় এবং ওজন সাত চল্লিশ কেজি-এর কম নয়, এমন ব্যক্তি বছরে চার বার, আর মহিলা হলে তিন বার রক্ত দিতে পারে। রক্তদানের বহুবিদ উপকার থাকলেও অমূলক ভীতি, ধর্মীয় জ্ঞানের দৈন্যতা, মানবসেবার মনোবৃত্তির অভাব, অসচেতনতা ইত্যাদির কারণে অনেকেই রক্তদানে অনাগ্রহী। অথচ রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগে কষ্ট পাচ্ছে অগণীত মানুষ।
২০০৮ সালের এক জরিপ মতে সারা বিশ্বে বছরে আট কোটি দশ লাখ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়। শুধু চট্টগ্রামে রক্ত লাগে সত্তর হাজার ব্যাগ। আর জনসংখ্যার শতকরা চারভাগ মানুষ রক্তদান করলে মোট চাহিদার তিনগুণ হবে (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ জুন, ২০০৮)। তাই রক্তদান-এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারীতা সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এ কর্মসূচির প্রতি উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
সন্ধানী, ফাতিমা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট, কল্যাণ, সিটিজি ব্লাড ব্যাংক, কণিকা যাঁরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে কাজ করছেন তাঁদেরকে আপন আপন অবস্থান থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়া দরকার। ধর্মীয়ব্যক্তিগণও এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারেন এ বলে যে, মানুষ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের প্রতি ভালবাসা মানে আল্লাহ তায়ালা প্রতি ভালবাসা।
মানবতার সেবা মানে আল্লাহ তায়ালার সেবা। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু নৈরাকার সেহেতু তাঁর ইন্দ্রিয়সেবা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আর না তিনি কারো সেবার মুখাপেক্ষী। অথচ তাঁর সন্তুষ্টি বিধান করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। সেই সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায় হলো মানুষের সেবা করা। দরিদ্রকে অর্থদান, বুভুক্ষকে খাদ্যদান, তৃষ্ণার্তকে পানিদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, রোগীকে সেবাদান ইত্যাদি আল্লাহ তায়ালার সেবা করার নামান্তর। এগুলো পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে প্রমাণিত।
বর্তমান যুগে মানবসেবার অন্যতম কর্মসূচি হলো রক্তমুখাপেক্ষী ব্যক্তিকে রক্তদান করা। তবে রক্তদান ও গ্রহণ একটি আধুনিক বিষয়। এ বিষয়ে ইসলামী বিধান কী- সেটি জানার আগ্রহ আছে অনেকের। আবার এটাকে অঙ্গহানির সাথে তুলনা করা অথবা বৈবাহিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় অথবা ভিন্নধর্মীর রক্তের অনুপ্রবেশ ইত্যাদি প্রশ্নে অনেকেই রক্তদান ও গ্রহণ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তাই এ বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন।
মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হানি করা বা বিকৃতি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। নিজের ব্যাপারেও কেউ এমন অধিকার রাখে না যে, সে নিজে নিজের অঙ্গহানি করবে অথবা বিকৃতি করবে। আত্মহত্যা তো ইসলামে মহাপাপ হিসেবে সাব্যস্ত। সুতরাং আল্লাহতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে, আমি আমার অঙ্গহানি বা বিকৃতি করবো। কারণ, মানুষ রূপক অর্থে সাময়িকভাবে তার শরীর, সম্পদ ইত্যাদির মালিক হলেও প্রকৃত ও স্থায়ী মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি বলেন, “নবম-ল আর ভূ-ম-লের সবকিছু আল্লাহরই মালিকানাধীন” (সূরা বাকারা: ২৫৫)।
অতএব নিজের জান-মাল অনর্থক নষ্ট করা, অঙ্গহানি বা বিকৃতি করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “তোমরা স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা” (সূরা বাকারা: ১৯৫)। এ আয়াত এবং অন্যান্য দলিলের আলোকে মরণোত্তর চক্ষুদান বৈধ হওয়া না হওয়া নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে রক্তদান আর মরণোত্তর চক্ষুদান এককথা নয়।
তাই রক্তদান কর্মসূচিকে ইসলামী শরিয়াবিশেষজ্ঞগণ কয়েকটি শর্তে জায়েয ফতোয়া দিয়েছেন। যথা, এক. যদি রক্তের অভাবে রোগী মারা যাওয়ার অথবা রোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে অথবা শারীরিক সুস্থতার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক কাউকে রক্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন তাহলে রক্তদান জায়েয (জাদিদ মাসায়েল, পৃ. ২৯)। দুই. যদি শারীরিক উন্নতি (যা রক্ত গ্রহণ ছাড়া অন্য উপায়ে সম্ভব) বা শারীরিক সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য রক্ত দান ও গ্রহণ জায়েয নয় (প্রাগুক্ত)। তিন. রক্ত বিক্রি বা রক্তব্যবসা জায়েয নয়। তবে বিনামূল্যে যদি রক্ত পাওয়া না যায় তাহলে ক্রয় করা জায়েয (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০। চার. দাতা ও গ্রহীতা ভিন্নধর্মী হওয়ার কারণে রক্তদান ও গ্রহণ নাজায়েয হবে না। তবে রক্তের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আছে বিধায় ভিন্নধর্মী বা পাপাচারী ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ না করতে পারলে ভাল। যেমন, পাপাচারী মহিলার দুগ্ধপান করানোর ব্যাপারে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। পূর্বযুগে দুগ্ধমাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা হতো (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১)। পাঁচ. স্বামী-স্ত্রী বা যাদের মধ্যে বিয়ে হবে তাদের পরস্পরের মধ্যে রক্তের আদান-প্রদান জায়েয। এমন নারী-পুরুষ, যাদের একজন অপরজনকে রক্ত দিয়েছে তাদের মধ্যে বিয়ে হতেও কোন বাধা নেই।
কারণ, বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে যে তিনটি সম্পর্ক প্রতিবন্ধক (বংশীয়, বৈবাহিক এবং দুগ্ধীয় সম্পর্ক) সেগুলোর মধ্যে রক্তদানের বিষয়টি পড়ে না। সুতরাং উক্ত তিনটি সম্পর্কের বাইরে অন্য কোন কারণে বিয়ে অবৈধ হওয়ার ফতোয়া দেয়া মানে শরিয়ত নির্ধারিত বিষয়ের অতিরঞ্জন করা। উল্লেখ্য যে, একই মায়ের দুধ পান করার কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক অবৈধ হওয়ার বিষয়টি আড়াই বছরের বয়সের সাথে শর্তযুক্ত। রক্তদানের ক্ষেত্রে উক্ত বয়স প্রযোজ্য নয় বিধায় দুগ্ধদানের সাথে এর তুলনা করার অবকাশ নেই (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২)।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, রক্তদাতার রক্ত বিশুদ্ধ কিনা তা পরীক্ষা করা আবশ্যক। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। এছাড়া গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী, হৃদরোগী, উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপের রোগী, ডাযেবেটিকস রোগী, মৃগী রোগী রক্ত দিতে পারবে না। সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, যার রক্তের কুফল রক্তগ্রহীতার মধ্যে পড়বে- যেমন, হেপাটাইসিস বি, এইচআইভি, মেলিরিয়া, সিফিলিসের রোগীর রক্তও গ্রহণ করা যাবে না।
যারা এমন ওষুধ সেবন করেন, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রক্তগ্রহীতার মধ্যে পড়বে- এমন রোগীর রক্ত গ্রহণ করতেও চিকিৎসকগণ বারণ করেন। তাঁরা রক্তদানের নিম্নোক্ত কয়েকটি উপকারিতা প্রমাণ করেছেন। যেমন, নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া (রক্তদান না করলেও এমনিতেই রক্ত নষ্ট হয়ে নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টি হয়), রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যাওয়া, নিজের শরীরে কোন মারাত্মক ব্যাধি আছে কিনা- তা চিহ্নিত হওয়া ইত্যাদি। অধুমপায়ীদের রক্তদানের ফলে হার্ট এ্যাটেক, বাইপাস অপরেশন এবং স্টোকের ঝুঁকি কমে যায়। এর মাধ্যমে শরীরের ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ জুন-২০০৮)।
এছাড়া রক্তদানের মাধ্যমে আত্মীয়তা সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়, শত্রুতা কমে যায়, অনাত্মীয়কে আপন করে নেয়া যায় এবং তার সাথে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়। পাশাপাশি নিজের অথবা আপনজনের প্রয়োজনে রক্ত পাওয়া যায়। “ত্যাগেই সুখ” প্রবচনের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে। এতে দারুণ মানসিক প্রশান্তিও লাভ করা যায়। রক্তদানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয়, যা বর্তমানে দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতেও এর গুরুত্ব অনেক। কারণ, একজনের রক্তদানে আরেকজনের জীবন বেঁচে যায় অথবা রোগী সুস্থ হয়ে যায়, যা একটি উত্তমসেবা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি কারো জীবন বাঁচাল সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচাল” (সুরা মায়িদা: ৩২)। রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করা আল্লাহর নবি (দ.)-এর দায়েমি সুন্নাত। তিনি একাধিক হাদিসে রোগীর সেবার তাগিদ দিয়েছেন; রোগী যে ধর্মেরই হোক না কেন। তিনি বলেন, “তোমরা বন্দীকে মুক্ত করো, বুভুক্ষকে খাবার দাও এবং রোগীর সেবা করো” (ছহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৩০৪৬)।
তিনি এটাকে মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ সুস্থ ও সক্ষম মুসলিমের দায়িত্ব হলো অসুস্থ মুসলিমের সেবা করা আর সেবা পাওয়া অসুস্থ মুসলিমের অধিকার; এটি তাঁর প্রতি করুণা নয়। এমনকি জীব-জন্তুর সেবাও ইসলামে নেক আমল হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস হলো, “একদা এক ব্যক্তি পথ চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ল এবং কূপের সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে পান করে তৃষ্ণা নিরারণ করল। তৃষ্ণা নিবারণের পর দেখতে পেল, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পিপাসায় কাতর হয়ে ভিজাভূমি লেহন করে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করছে। লোকটি চিন্তা করল যে, আমাকে যেমন তৃষ্ণায় পেয়েছিল কুকুরটিও তৃষ্ণায় কষ্ট পাচ্ছে। সে পুনরায় উক্ত কূপে অবতরণ করে তার মৌজা ভিজিয়ে তা মুখে ধারণ করে কুকুরটিকে পান করাল। ফলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।” হাদিসটি শুনার পর সাহাবিগণ (র.) জিজ্ঞাসা করলেন, জীব-জন্তুর সেবাতেও কি পূণ্য আছে? তিনি বললেন, “সর্বজীবের সেবাতে পূণ্য আছে” (প্রাগুক্ত, হাদিস নং-২৩৬৩)। এ জন্য বলা হয়েছে, “জীবে দয়া করে যেজন, সেজন সেবিছে ইশ্বর”।
রক্তদান একটি মহৎ ও সাওয়াবের কাজ। এই কর্মসূচি পালন করা, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, যোগাযোগ রক্ষা করে রক্তের ব্যবস্থা ও সন্ধান দেয়া ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও সংস্থা আল্লাহ তায়ালার দরবারে মানবতার সেবক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
পবিত্র হাদিসের ভাষ্য মতে, তারা আল্লাহ তায়ালার সেবক। পরস্পরের মাঝে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং সহমর্মিতাপূর্ণ সমাজ গড়ার অন্যতম কর্মসূচিও হতে পারে স্বেচ্ছায় রক্তদান। নানাবিধ কুকর্ম থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখেতে এ জাতীয় কর্মসূচি খুবই ফলপ্রসূ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।